দোহারের সেই চাঞ্চল্যকর ডাবল মার্ডারের জট খুললো যেভাবে

রাজিয়ার আইনজীবী এডভোকেট শ্রেষ্ঠ আহমেদ রতন বলেন, এ ঘটনায় রাজিয়া বেগম প্রথমে দোহার থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ  সেদিন মামলা না নিয়ে দুই দিন পর জিডি নেন। পরে  ছেলের সন্ধান না পেয়ে মা আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে তদন্তের আদেশ দেন। দোহার থানা মামলাটি গ্রহণ করে কিছুদিন তদন্ত কার্যক্রম করেন। তথ্য প্রযুক্তির বিষয় জড়িত থাকায় পরে দোহার থানা মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করেন।  সিআইডি’র তদন্ত শুরু করেন। এক পর্যায়ে এ ঘটনায় সোহাগ ব্যাপারী ও ইয়াছিন মোল্লাকে আটক করে সিআইডি। তারা  ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। বেরিয়ে আসে সাইদুল ও সোহেলকে নির্মমভাবে হত্যা করার আদ্যোপান্ত।

জোড়া হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সোহাগ ব্যাপারী ও ইয়াছিন মোল্লা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সোহাগ ব্যাপারী দোহার থানার ডুলি হাসির মোড় গ্রামের এমদাদুলের বাসায় থাকতো। ওই বাসায় থেকে মোটরসাইকেলের মিস্ত্রির কাজ করতো। সেই সুবাদে এমদাদ, সাজ্জাত মোল্লা, কাওছার মোল্লা, মনির শেখ, ইয়াসিন, আলিমদার ও ইয়াসিনের ভাতিজার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

জবানবন্দিতে সোহাগ ব্যাপারী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলে, ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে সাজ্জাত মোল্লা ও এমদাদ আমাকে বলে, আমরা বোটে (ট্রলার) করে মাওয়া ব্রিজ দেখতে যাবো। তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাবা? তাদেরকে বলি- যাবো। ঘটনার দিন এমদাদ আমাকে সাজ্জাত মোল্লার বাসায় যেতে বলে। সে আমাকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে বাঁশতলার আজিমের  কাছে যেতে বলে। সেখানে গেলে আজিম টাকা রেখে ৩৫টি ইয়াবা দিয়ে বোটে যেতে বলে। আমি বোটে যাই। সেখানে এমদাদ, আলিমদার, মনির, কাওছার, ইয়াসিন ও তার ভাতিজা বসা ছিল। ১০/১২ মিনিট পরে সাজ্জাত মোল্লা একটা ব্যাগ ও দুইজন ছেলেকে নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পর বোটে আবার দোহারের দিকে ফিরতে থাকি। ব্রিজ থেকে ৪/৫ কিলোমিটার আসার পর পদ্মা নদীর একটা চরে বোট থামে। বোট থেকে তখন সবাই নেমে ইয়াবা ও মদ খায়।  ম্যাজিস্ট্রেটকে আরও জানায়, পদ্মার চর থেকে সাইদুল তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানায়, আমি আজ ফিরবো না। আগামীকাল ফিরবো। মদ খাওয়া শেষ হলে প্রথমে রিভলবার দিয়ে সাইদুলের পিঠে গুলি করে। সে পড়ে যায়। এরপর সাজ্জাদ মোল্লা সোহেলের মাথায় নৌকার  বৈঠা দিয়ে বাড়ি দেয়। তখন এমদাদুল রিভলবার দিয়ে সোহেলকে গুলি করে। এরপর ওরা সবাই মিলে সাঈদুলের গলায় রশি দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে চাপ দেয়।  সাইদুল মারা যায়। তখন ওরা সোহেলের গলায় একইভাবে প্যাঁচ দিয়ে চাপ দেয়। সোহেলও মারা যায়।

এরপর সবাই মিলে বালি খুঁড়ে গর্ত করে লাশ ২টা- একই গর্তে রেখে বালু দিয়ে চাপা দেয়।  এরপর ওই গর্তের বালুর উপরে ডিজেল ঢেলে দেয়। এরপর আমরা সবাই বোটে উঠি। হঠাৎ সাজ্জাত মোল্লার মোবাইলে ফোনে একটা কল আসে। তখন সাজ্জাত মোল্লা বলেন, ওদের দুইজনকে মেরে ফেলেছি। তখন ফোন করা লোকটা বলে, তোরা ইন্ডিয়া গিয়ে পাসপোর্ট কর। তোদের আমি ইতালি নিয়ে আসবো।  ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়া আরেক আসামি হলো মো. ইয়াসিন মোল্যা। ইয়াসিন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলে, ঘটনা ছিল রোজার ৭ম দিন। সেদিন দুপুরের দিকে ইমদাদুল আমাকে ফোন করে মুকসেদপুর ঘাটে যেতে বলে। মুকসেদপুর বাজারে আমার সঙ্গে মনিরের দেখা হয়। তার দুই হাতে দুই ড্রাম ২০ লিটার ডিজেল ছিল। আমি তার সঙ্গে ঘাটে গিয়ে দেখি একটি বোটে সাজ্জাত মোল্যা, ইমদাদুল, আলিমদার, সোহাগ মোল্যা, কাওছার মোল্যা, রাজন, সোহেল ও সাইদুল বসে আছে। তারপর সাজ্জাত মোল্যা আমাকে বোট চালিয়ে মাওয়া ঘাটের দিকে যেতে বলে। তখন প্রায় ৩টা বাজে। আমি বোট চালিয়ে পদ্মা ব্রিজের কাছে যাই।  সেখানে আমরা পদ্মা ব্রিজ ঘুরে দেখি। এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে যায়।

সন্ধ্যার পর ইমদাদুল আমাকে বোট ঘুরিয়ে দোহারের দিকে যেতে বলে। বোটটি ছিল চঞ্চল মোল্যার। কিছুদূর আসার পর ইমদাদুল পদ্মার একটি ছোট্ট বালুর চরে বোট থামাতে বলে। তখন ওরা সবাই বোট থেকে নেমে ইয়াবা আর মদ খায়। ইমদাদুল কিছুক্ষণ পর সাইদুলের পিঠে গুলি করে। তখন সোহেলকে বোটের বৈঠা দিয়ে আলিমদার আর সোহাগ বাড়ি দিয়ে ফেলে দেয়। তখন সাজ্জাত গুলি করে। এরপর নাইলনের দড়ি দিয়ে সবাই মিলে সোহেল ও সাইদুলের গলায় প্যাঁচ দিয়ে চাপ দেয়। ওরা মারা যায়। গর্ত খোঁড়া হলে ওরা সবাই মিলে সোহেল আর সাইদুলের লাশ ওই গর্তে ফেলে। ইমদাদুল একটা ড্রাম এনে ডিজেল ফেলে দেয়। তারপর সবাই মিলে বালু দেয়। এরপর আবার ডিজেল ঢালে। তারপর সবাই আবার বোটে উঠে রওনা দেয়। এ সময় সাজ্জাত মোল্যা ফোনে একজনকে জানায়, দাদা কাজ হয়ে গেছে। দুইটারেই মেরে বালু চাপা দিয়ে দিয়েছি।

শেয়ার করুন:

Recommended For You