
সদ্য অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রত্যাখান করে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক লিখিত বক্তব্যে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন- “আমরা পশ্চিমাবিশ্বের কাছে আহ্বান জানাবো, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করে আপনারা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মত কঠিন পদক্ষেপ না দিয়ে সরকারের উপর কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখুন, যাতে তাঁরা নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ নেয়। এই আহ্বান আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকটও। আমরা চাই, অবিলম্বে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। নতুন যে সরকার এবং সংসদীয় বিরোধী দল গঠিত হতে যাচ্ছে তাঁর প্রতি জনসমর্থন নেই বিধায় এই সরকারের বিকল্প হিসেবে আমরা সব বিরোধী রাজনৈতিক দল মিলে যদি একটি “ছায়া সরকার” গঠন করতে পারি তাহলে আমরা একটি “জনতার সংসদ” গড়ে তুলতে পারব।”
পূর্ণ লিখিত বক্তব্যঃ আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, শুভেচ্ছা নিবেন। আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এনডিএম কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবার জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আকাশে যে কালো মেঘের দেখা দিয়েছে, যে অপশক্তি এই জনপদের সাড়ে সতেরো কোটি জনগণের ঘাড়ে চেপে বসেছে, গণতন্ত্র হত্যার যে বীভৎস উল্লাস আওয়ামী মাফিয়া সরকার চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, তা থেকে দেশ এবং জনগণকে মুক্ত করতে আজ আপনাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রিয় বন্ধুগণ, লিখিত বক্তব্যের শুরুতে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সেইসব অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যাদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিলো। কারণ আজ তাঁদের আত্মত্যাগ আর বিসর্জন লুট হয়ে গেছে। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বিরোধী দলের সেইসব নেতা-কর্মীদের পরিবারের কাছে যারা গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন বলে কেউ সন্তান হারিয়েছেন, কেউ প্রিয় বাবাকে হারিয়েছেন, স্বামীকে হারিয়েছেন বা ভাইকে হারিয়েছেন। কারণ আমরা তাঁদের ত্যাগের ফসল দেশের জনগণকে উপহার দিতে পারি নাই। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি প্রতিহিংসার পেট্রল বোমায় যারা পুড়ে নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারের প্রতি কারণ বাংলাদেশকে তাঁদের জন্য আজও নিরাপদ জনভূমিতে রুপান্তর করতে পারি নাই।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, আমাদের এইসব আফসোস আর হাহাকার শুধুমাত্র এক ব্যক্তির ক্ষমতার লিপ্সার জন্য। আমাদের এই হাহাকার একটি মাফিয়া গোষ্ঠীর লুটপাটকে দীর্ঘস্থায়ীর করার ষড়যন্ত্রের জন্য। আমাদের এই দীর্ঘশ্বাস বাংলাদেশের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার আর নাগরিক মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে সেই জন্য। গত ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পুরো বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর গণতন্ত্রের দেশ হিসাবে তুলে ধরেছে। আবারো প্রমাণিত হয়েছে, কূটকৌশলে প্রকৃত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রেখে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে “আমি” আর “ডামি” মার্কা নির্বাচন করে জনগণের ম্যান্ডেট বিহীন আরেকটি কথিত সরকার বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করতে যাচ্ছে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম এই প্রহসনের কথিত নির্বাচনকে প্রত্যাখান করছে। আমরা নির্বাচনে ঘটে যাওয়া অনিয়ম বা কারচুপির চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন কিভাবে নির্বাচনের নামে একটি প্রহসনকে রাষ্ট্রীয় মদদে মঞ্চস্থ করা হলো এবং এর সম্ভাব্য বৈশ্বিক প্রভাব কি সেটা নিয়ে।
প্রিয় বন্ধুগণ, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন পরবর্তী বিদেশী সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের সাথে মতবিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিরোধী শক্তির প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেছেন তা জাতির জন্য লজ্জার। এই নির্বাচনে ভোটার টানতে গ্রাম পর্যায়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতের ভাতা কার্ড এবং বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়ে সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছে। এতকিছুর পরেও এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিলো একেবারেই নগন্য। নির্বাচন ছিলো সরকারের ইচ্ছাধীন। নিজ দলের পদধারী ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে একপ্রকার নিয়ন্ত্রিত এবং তামাশার নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ দেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোন রাজনৈতিক দলই নৌকার বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে নাই। আওয়ামী লীগ মনোনীত, আওয়ামী লীগ সমর্থিত এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই শুধু জয়লাভ করেছে। কথিত কিংস পার্টির চেয়ারম্যান-মহাসচিবসহ প্রায় সব প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় পাওয়া দেশের সবচেয়ে নির্লজ্জ রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির নির্বাচিত ১১ জন সংসদ সদস্য ছাড়া দলটির অধিকাংশ প্রার্থী জামানত খুইয়েছেন। বিরোধী মহল থেকে সরকারের প্রলোভনে নির্বাচনে যাওয়া কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান ছাড়া দলটির সব প্রার্থী শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছেন। দলটির চেয়ারম্যানকে জেতাতে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের চাপ সৃষ্টি করেছে বলে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও জমা পড়েছিলো। নির্বাচনের দিন কক্সবাজার-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বর্তমান সাংসদ অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন বর্জনও করেছে। জয়ের দেখা পায়নি অংশ নেয়া ২৮টি রাজনৈতিক দলের ২৩টি, এমনকি এই দলগুলো কোথাও নূন্যতম প্রতিন্দ্বদ্বিতাও গড়ে তুলতে পারে নাই।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ, নির্বাচনের এই চিত্র বলে দেয়, প্রধানমন্ত্রী জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছে বলে যে বক্তব্য রেখে চলেছেন তা সর্বৈব মিথ্যা এবং ভয়ংকর একধরণের প্রতারণা। এই নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগের ইচ্ছাধীন- সাজানো, পাতানো এবং খেলাধুলার নির্বাচন।
নির্বাচনের মূল সংজ্ঞা হলো যথাযথ বিকল্প থেকে বেছে নেবার সুযোগ। নিরপেক্ষ নির্বাচন মানে শুধু নির্বাচনের দিন শান্তিপূর্ণ থাকা বা সঠিকভাবে ভোট গণণা নয়। অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন মানে প্রত্যেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল সারাবছর অবাধ রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ পাবে, কালো টাকা এবং পেশীশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হবে, নির্বাচনের প্রচারে সবদল সমান সুযোগ পাবে, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সরকারের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে এবং নির্বাচনের দিন ভোটারগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের ভোটের গুরুত্ব আছে এটা মনে করে ভোট দিবে এবং ভোটের ফলাফল ঘোষণা যথাযথভাবে হবে। এই প্রহসনের নির্বাচনে এই সবগুলো উপাদানই অনুপস্থিত ছিলো।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,আমরা পশ্চিমাবিশ্বের কাছে আহ্বান জানাবো, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করে আপনারা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মত কঠিন পদক্ষেপ না দিয়ে সরকারের উপর কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখুন, যাতে তাঁরা নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ নেয়। এই আহ্বান আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকটও। আমরা চাই, অবিলম্বে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। নতুন যে সরকার এবং সংসদীয় বিরোধী দল গঠিত হতে যাচ্ছে তাঁর প্রতি জনসমর্থন নেই বিধায় এই সরকারের বিকল্প হিসেবে আমরা সব বিরোধী রাজনৈতিক দল মিলে যদি একটি “ছায়া সরকার” গঠন করতে পারি তাহলে আমরা একটি “জনতার সংসদ” গড়ে তুলতে পারব।
আমরা স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিশ্চয়তা চাই। মিথ্যা এবং সাজানো মামলায় কারাগারে থাকা সকল রাজবন্দির মুক্তি চাই। আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে জনগণ এবং তরুণ প্রজন্মের সহায়তা চাই। শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। প্রত্যাশিত একটি নির্বাচন এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার দাবিতে লড়ে যাবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম। ইনশাআল্লাহ্, বিজয় আমাদের হবেই।
জয় বাংলাদেশ।