
জিয়াউল হক—
(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
১৬.
পরের দিন আজিম আর আবুল দুবন্ধু গেল নয়শাল চাচার সাথে দেখা করতে। নানা কুশল বিনিময়ের পর আজিম বলল, চাচা আমার বিয়ে উপলক্ষে গাঁয়ের লোকদের একবেলা খাওয়ানোর আয়োজন করলে কেমন হয়?
— আজিম তুমি ভালো কথাই বলেছো। গাঁয়ের লোকজনের পাশাপাশি তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকদেরও দাওয়াত দাও।
— চাচা আপনি নিজে উপস্থিত থেকে নিজ হাতে সব কিছুর আয়োজন করবেন। আমি শুধু আপনার হুকুম পালন করবো।
— ঠিক আছে, তাহলে কাল সকালে আমাদের সমাজের মালিথা জব্বার প্রামানিকের সাথে বসে কত জন লোককে খাওয়ানো হবে, কী কী বাজার করতে হবে সব কিছু ফাইনাল করা যাবে।
সে মতে জব্বার প্রামানিকের সাথে পরামর্শ করে পরের শুত্রবারে বাদ জুম্মা আজিমের বাড়িতে গাঁয়ের লোক ও আজিমের শ্বশুর বাড়ির লোকদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হল। প্রায় সাত দিন শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করার পর সেদিন রাতেই মনোয়ারার বাবা আহেদ আলী সরদার জামাই মেয়ে দুজনকে নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় মনোয়ারা আবুলকে পরের দিন তাদের বাড়িতে আসার জন্য দাওয়াত দিয়ে গেল।
আজিম বলল, মন খারাপ করে ঘরে বসে না থেকে তোর ভাবীর দাওয়াত মতো কাল সকাল সকাল তুই চলে আয়। আমরা তোর মন ভাল করার ওষধের ব্যবস্থা করে রাখব।
আজিমের বিয়ে উপলক্ষে গত সাত দিন আবুলের বেশ ব্যস্ততায় কেটেছে। বিয়ের বাজার করা, বরযাত্রি নিয়ে কন্যার বাড়ি যাওয়া, সমস্যা হতে পারে অনুমান করে গোপনীয়তা রক্ষা করাসহ একটা বিয়েতে কতই না কাজ থাকে। সবকিছুই আবুলকে সামলাতে হয়েছে। তাছাড়া বিয়ে উপলক্ষে আজ আজিম তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন ও গাঁয়ের সকল মানুষদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর জন্য একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এর জন্য নয়শাল চাচার সাথে পরামর্শ করে খাবার মেনু ঠিক করা, বাবুর্চির সাথে একসাথে রান্নায় সহযোগিতা করা, নতুন মেহমানদের সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানানো, রান্না শেষে মেহমান ও গাঁয়ের লোকদের খাবার পরিবেশন করা থেকে শুরু করে সব কিছুই তাকেই সামলাতে হয়েছে। সব জায়গায় ছিল তার কঠোর নজরদারী। অনুষ্ঠান শেষে নতুন বৌসহ আজিম শ্বশুর বাড়ি যাত্রা করার পরই তার ছুটি মিলল।
সারা দিনের এতো সব কাজ করে এখন সে বড্ড ক্লান্ত। শরীর অবষণ্ন। বাড়ি ফিরে যাওয়ার শক্তিও যেন তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। তবুও অতি ধীর পদক্ষেপে সে তার ক্লান্ত পা দুটোকে ফেলে বাড়ির পথে যাত্রা করল।
গত কয় দিন খুব ব্যস্ততায় মধ্যে থাকায় প্রিয়তমা সানোয়ারাকে নিয়ে দেখা তার সেই দুঃস্বপ্নের কথা একবারের জন্যও মনে পড়েনি। একা একা পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ করেই তার মনে পড়ল সেই দুঃস্বপ্নের কথা। আর মুহূর্তের মধ্যেই তার বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা শুরু হল। সে ভেবে পায় না সানোয়ারাকে হারানোর কথা মনে হলেই কেন তার বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়? কেন তার বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগে? বুকের মধ্যে নতুন করে ব্যথা শুরু হওয়ার পর তার হাঁটার গতি আরও কমে গেল। তাইতো তার বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। আজিমদের বাড়ি থেকে খেয়েই এসেছিল। এখন সে এতোটাই ক্লান্ত যে জামা কাপড় না খুলে হাত মুখ না ধুয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে মরার মতো বিছানায় পড়ে রইল। কিন্তু তাতে শরীরের ক্লান্তিতো দূর হলই না, বরং নানা দুশ্চিন্তায় তার চোখের ঘুম যেন কোথায় পালিয়ে গেল। সারা পৃথিবী ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে। রাতজাগা পাখিদের করুণ আর্তনাদ যেন তার বুকে ব্যথার বীণা বাজাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা নিজেই জানে না। আর ঘুমের মধ্যে আবার একই দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। দ্বিতীয় বার একই দুঃস্বপ্ন দেখার পর তার বুকের ভেতরের চিনচিনে ব্যথাটা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
এই দুঃসহ ব্যথা বুকে নিয়ে রাতে যে তার আর ঘুম আসবে না তা বুঝতে পেরেই সে বিছানা থেকে উঠে ঘরের মধ্যেই পায়চারি করতে করতে ভাবতে থাকে কেন সে বার বার একই দুঃস্বপ্ন দেখছে? এর পেছনে সত্যিই কি কোন কারণ আছে? কিন্তু এর উত্তর তার জানা নেই। মনোয়ারা ভাবী কাল তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিয়ে গেছে। সকালে সেখানে গিয়ে ভাবীর সাথে আলোচনা করে প্রকৃত তথ্য না জানা পর্যন্ত রহস্য উদ্ঘাটন করা যাবে না। কিন্তু রাতের প্রহর যেন স্থির দাঁড়িয়ে আছে, ঘড়ির কাটা যেন থেমে গেছে। তাইতো রাত পোহানোর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
কথায় আছে রাত যত গভীর হয়, সকাল ততো ঘনিয়ে আসে। দুঃখের দীর্ঘ রজনী শেষে অবশেষে রাতের আঁধার কেটে নতুন সকালের দেখা মেলে। নির্ঘুম একটা রাত কাটানোর পরও দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে আবুলের শরীরের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায় কোন এক যাদুর স্পর্শে। মনোয়ারা ভাবী তাকে দাওয়াত দিয়ে গেছে। আজ যে সে তার প্রিয়তমা সানোয়ারার সাথে দেখা করতে যাবে। নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা হবে, কথা হবে, তার মন থেকে চিরতরে দূর হয়ে যাবে প্রিয়তমা নিয়ে দেখা দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করতে যাওয়াতো আর যেমন-তেমনভাবে যাওয়া যায় না। তাই বেশ সেজেগুজে একটু সকাল সকালই সে যাত্রা করল আজিমের শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। সত্যি কথা বলতে কি, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেল আজিমের শ্বশুর বাড়িতে।
আবুলকে দেখে আজিম ও তার নতুন বৌ খুশি হওয়ার পরিবর্তে বরং তাদের দুঃশ্চিন্তাই যেন আরও বেড়ে গেল। কারণ রাজ্যের বিষন্নতা যেন ভর করেছে তার চোখে মুখে। তার এই বিষন্ন ভাব দেখে আজিম চিন্তিতভাবে বলল কিরে দোস্ত, এক রাতেই শরীরের একি চেহারা বানিয়েছিস। আজ যে তোকে আরও বেশি বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে।
— আরে বলিস না গত কয়দিন তোর বিয়ের কাজে ব্যস্ত থাকায় বেশ ভালই ছিলাম। গত কাল তোরা চলে আসার পর আমার দুঃশ্চিন্তা যেমন বেড়ে যায়, তেমনি রাতের ঘুমের মধ্যে আবার সেই দুঃস্বপ্নটা দেখে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। তাইতো শরীরের এই অবস্থা হয়েছে।
এ কথা শুনে আজিমের নতুন বৌ বলল, কেন চিন্তা করছেন ভাই? এখনই আমার সই সানোয়ারাকে ডেকে আনছি। তারপর আপনারা দুজন কথা বলে মনের সকল দুঃশ্চিন্তা দূর করুন, নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করুণ।
মনোয়ারার কথা শুনে আবুল ছলছল দৃষ্টি মেলে বলল, তা হলেতো ভালই হয়।
আবুলের চোখে মিনতি ভরা দৃষ্টি দেখে একটুও দেরি না করে মনোয়ারা তাদের বাড়ির কাজের মেয়েকে সখি সানোয়ারাকে ডেকে আনার জন্য পাঠিয়ে দিল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কাজের মেয়ে ফিরে এসে মনোয়ারার হাতে একটা চিঠি দিয়ে জানালো সে আসতে পারবে না। এ কথা শুনেই মনোয়ারা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। যখন খুশি তখন মনোয়ারা সানোয়ারাদের বাড়ি যায়। আবার সানোয়ারাও বিনা নোটিশে মনোয়ারাদের বাড়িতে এসে সময় কাটায়। এখন এমন কী ঘটল যে সে আসতে পারবে না? তাই কাজের মেয়ের হাত থেকে সখির দেওয়া চিঠি নিয়ে পড়তে শুরু করলো। আজিম আর আবুল মনোয়ারার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই চিঠির ভাষা বুঝতে চেষ্ঠা করল। কিন্তু তারা খুব বেশি একটা বুঝতে পারল না। চিঠি পড়েই মনোয়ারা জানতে পারল তার বিয়ে হওয়ার পর দিন থেকেই সখির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, বাড়ি থেকেও তাকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু তাই না সানোয়ারা যাতে কোন দিনই মনোয়ারার সাথে দেখা না করে বা মনোয়ারার মতো কোন গর্হিত কাজের সাথে জড়িত হয়ে না পড়ে তার জন্য তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। চিঠির শেষ অংশে অবশ্য সে যে আবুলকে ভালোবাসে এবং সেই ভালোবাসার মূল্য দিতে যে কোন ত্যাগ স্বাীকার করতে রাজি আছে বলে সে দৃঢ়তার সাথে জানিয়েছে। তাছাড়া সুযোগ পেলেই সে সখির সাথে দেখা করার নিশ্চয়তাও দিয়েছে।
চিঠি পড়ে মনোয়ারা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ল। তা মুখে প্রকাশ না করে বরং তা পড়ার জন্য আবুলের হাতে তুলে দিল। আবুল বেশ কয়েক বার চিঠিটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ল। চিঠির প্রতিটা ছত্রেই তার জন্য নিরাশার কথা লেখা থাকলেও গত কয়দিন ধরে তার মনে যে হতাশার কালো কাল মেঘ জমেছিল তা যেন একেবারেই কেটে গেল। মেঘমুক্ত আকাশের মতো তার মলিন মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কারণ সে ভাবল সবাইতো আর আজিমের মতো ভাগ্যবান হবে না যে কোন দুঃখ বা কোন কষ্ট ছাড়াই ভালোবাসার মানুষকে জীবন সাথি হিসাবে পেয়ে যাবে। বরং যাকে সে ভালোবাসে, যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে সেও যে তাকে ভালোবাসে এবং সেই ভালোবাসার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে— একজন প্রেমিকের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়া থাকতে পারে। বিনি সুতার মালার এই সম্পর্কের জন্যই যুগে যুগে কত লাইলি-মজনু, কত শিরি-ফরহাদ তাদের অমর প্রেম কাহিনির জন্য জগতে অমর হয়ে আছে। আবুলরা দুজনও তাদের ভালোবাসা দিয়ে রচনা করতে চায় প্রেমের নতুন ইতিহাস। তাইতো গত সাত দিন তার যে মন খারাপ ছিল তা থেকে মুক্ত হয়ে মুহূর্তেই সে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রিয়তমার সাথে দেখা না হওয়া সত্বেও সারা দিন আজিম ও নতুন ভাবীর সাথে আনন্দে কাটিয়ে বিকেলের দিকে হাসিখুশি মন নিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত হল।
তারপর সে মনোয়ারা ভাবীকে বলল, আপনি আমার সানোয়ারাকে দেখে রাইখেন। শুধু আপনার সহযোগিতার মাধ্যমেই আমাদের দুজনের স্বপ্ন পূরণ হবে ইনশাল্লাহ।
আবুলের বিদায় মুহুর্তে আজিম বলল, আমাকে আরও দুই এক দিন এখানে থাকতে হবে। সুযোগ করে একদিন দেখা করে যাস। এরই মধ্যে তোর ভাবীর মাধ্যমে ভালো কোন খবরও পেয়ে যেতে পারিস।
অবশ্যই আসব বলে আবুল বাড়ির পথে যাত্রা করল। আজিম আর মনোয়ারা অনেক সময় ধরে আবুলের যাত্রাপথের দিকে চেয়ে রইল। তারপর আজিম বলল, ছোট বেলা থেকেই আমরা দুজন একসাথে বড় হয়েছি। সুখে-দুঃখে দুজন পাশাপাশি থেকেছি। দুবন্ধু একসাথেই তোমাদের দুই সখিকে ভালোবেসেছি। অথচ নিয়তির কী খেলা দেখ, আমাদের দুজনের স্বপ্ন পূরণ হলেও আবুলের স্বপ্ন পূরণের পথে কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে সানোয়ারার বাবা। জানি না বন্ধুর মনের আশা পূরণ হবে কিনা? তা না হলে দুঃখের স্মৃতি বুকে নিয়েই তাকে সারাজীবন কাটাতে হবে।
— আবুল ভায়ের জন্য আপনি অতো চিন্তা করবেন না। সে অনেক ভালো ছেলে। সংসারের অবস্থাও ভালো। চাচির মাধ্যমে চাচাকে ভালোভাবে বুঝাতে পারলে হয়তোবা তিনি সানোয়ারার সাথে আবুল ভায়ের বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন।
— তুমি জান না মনোয়ারা, সমতলের লোকগুলো আমাদের চরের মানুষদের মানুষ ভাবে না। চরের কোন ভালো ছেলের সাথেও তারা নিজেদের মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। আমার শ্বশুর বাবাজি খুব ভাল মানুষ তাই তিনি আমার সাথে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু সবাই যে রাজি হবে তা আমার মনে হয় না।
— ঠিক আছে। আমাদের চেষ্টা করে দেখতেতো দোষ নেই।
— তা তুমি ঠিকই বলেছ। একটু চেষ্টা করে দেখ আমার বন্ধুর কোন উপকার করতে পার কিনা?
— অবশ্যই চেষ্টা করব।