ক্রিকেট বাণিজ্যে বন্ধু যখন শত্রু !

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অকৃত্রিম বন্ধু আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত । ১৯৭১ সাল বাংলাদেশে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন পড়শি দেশ হিসেবে ভারত ও দেশটির সাধারণ মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।  ভারতের গণমানুষের সহযোগিতার সেই ইতিহাস তাৎপর্যপূর্ণ ও গৌরবের বটে। প্রায় এক কোটি মানুষ দেশান্তরিত হয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। শুধু তাই নয়, ভারত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে আরেক ভূখন্ডের মানুষের স্বাধীনতার রক্তাক্ত যুদ্ধে।

পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের মাটি ও মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ভারত সরকার একদিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন শরণার্থীদের, অন্যদিকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানগুলো পরিণত হয়েছিল মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এভাবেই একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখতে শুরু করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ভূমিকা রাখতে ভারতকে হারাতে হয়েছিল বহু অফিসার ও সৈনিককে। ১৯৭১ সালে র্পূব ও পশ্চিম রণাঙ্গন মিলে শহীদ ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা ৩৬৩০ জন, নিখোঁজ ২১৩ জন এবং আহত ৯৮৫৬ জন। যাঁদের রক্ত এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মিশে রয়েছে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ভারত বন্ধু হিসেবেই আমাদের কাছে পরিচিত । ভারতের এই অবদান আমাদের নতুন প্রজন্মও কম বেশি জানে । প্রতিনিয়তই আমরা তাঁদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান । তারাও বেশ আগ্রহের সাথে নিচ্ছে বিষয়টা । এতে করে ভারতের প্রতি নতুন প্রজম্মের একটা চাওয়া-পাওয়া, আবদার কাজ করে । তারা আশা করতেই পারে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের মতই ভারত থাকবে আমাদের সুখে-দু:খে ।

আমাদের মুক্তির সংগ্রামের বয়স পেরিয়ে গেছে ৫০ বছরের বেশি । এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতকে দিতে হয়েছে তার বন্ধুত্ব রক্ষার নানান পরীক্ষা । ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বন্টন, সীমান্তে হত্যার মত ইস্যু নিয়ে ভারতের বন্ধুত্ব বাংলাদেশের তরুণ প্রজম্মের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে বহুবার ।  সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট বাণিজ্য নিয়ে ভারত যা করছে বাংলাদেশের সাথে, তাতে আবার নতুন প্রজম্মের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ তাদের বন্ধুত্ব ।

অনেকই মনে করতে পারেন, ক্রিকেট একটা খেলা মাত্র এ নিয়ে কেন দুই প্রতিবেশি  রাস্ট্রের বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নিয়ে প্রশ্ন আসবে ? আসলে সাম্প্রতিক সময়ে এই উপমহাদেশে ক্রিকেটকে তারাই রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে । শুধুমাত্র পাকিস্তানের সাথে ভারতের বৈরি সম্পর্কের কারণে আইপিএল’র মত টুর্ণামেন্টে খেলার সুযোগ পায় না । বাবর আজম, রিজওয়ান বা তাদের পূর্বশুরিরা । আমাদের নতুন প্রজন্ম তো স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেনি । তারা শুনেছে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা । কিন্তু বর্তমানে তাদের সামনে বারবারই চলে আসে ক্রিকেট মাঠে ভারতীয়দের শত্রু সুলভ আচরণ । শুধু মাত্র ক্রিকেটকে বাণিজ্যিক রুপ দেয়ার জন্য ভারত যা করছে,তা তো বন্ধু-বন্ধুর সাথে করতে পারে না।

পূর্বের যত ঘটনা বাদ দিলেও, চলতি বিশ্বকাপে এডিলেডে সাকিব-লিটনদের সাথে যে ঘটনা চিত্রায়িত হয়েছে  এর পর থেকে ক্রিকেট পাগল বাঙালী জাতির তরুণ প্রজন্ম সেটা কীভাবে নিয়েছে । তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে শুরু করে পাড়া-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে একই আলোচনা । সমালোচনায় বিদ্ধ ভারতের বন্ধুত্ব । নিজেদের মুনাফা অর্জনের জন্যই কি ভারত এমন করছে ?  তাহলে কোথায় তাদের বন্ধুত্ব ? এমনভাবে চলতে থাকলে আমরা কি আর পারবো ভারতের বন্ধুত্বের গল্প নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ?

অথচ, ২০০০ সালের জুন মাসটি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটি অবিস্মরণীয় দিন। এই মাসটিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। আরো স্পষ্ট করে বললে ক্রিকেটের ক্ল্যাসিক ফর্ম টেস্ট খেলার অধিকার লাভ করে। এই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ব্যাপারটা সহজ ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মোড়ল দেশগুলো বরাবরই ছিল বাংলাদেশের মতো দলের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার বিপক্ষে। কিন্তু সেসময় বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন আইসিসি’র সেসময়কার প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া। এই ভারতীয়’র অকৃত্রিম সহযোগিতায় আমারা সেদিন টেস্ট মর্যাদা লাভ করি । কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আর ক্রিকেট বাণিজ্যের যাঁতাকলে সেটা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে শুধুই রূপ কথার গল্প । তারা এই ভারতকে শুধু শত্রু হিসেবেই জানছে, বন্ধু নয় !

লেখক, নাসির পাঠান 

গণমাধ্যমকর্মী, ঢাকা । 

 

 

 

শেয়ার করুন:

Recommended For You