পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার (২৫ জুন) দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছেন। এর মাধ্যমে খুলে গেছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপরাপর অংশের সরাসরি সংযোগ, যোগাযোগ ও সম্ভাবনার দুয়ার। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পদ্মা সেতু যোগাযোগ সংযোগ সহজ করার সঙ্গে একইসাথে অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলবে। বদলে দেবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চালচিত্র।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন দেশের দু’জন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। তারা বলেছেন, পদ্মা সেতু হয়ে উঠবে পুরো দেশের অর্থনৈতিক করিডরের মূলকেন্দ্র এবং অপকল্পনীয় পরিবর্তন আনবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান মনে করেন পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনেতিক মুক্তির এক অনন্য প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবেই দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এ অঞ্চলের একুশটি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এই সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আর ঝড়বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না।

তিনি আরও বলেন, সেতুটির কারণেই এই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে এসেছে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এই অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে।

আতিউর রহমান একটি গবেষণা জরিপের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। আরও সহজ করে বলা যায়, আগামী পাঁচ বছরে দশ লাখ অর্থাৎ বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। দশ বছর পর এই সংখ্যা তিনগুণ হয়ে যাবে। দক্ষিণ বাংলায় বাংলাদেশের সাতাশ শতাংশ মানুষের বাস। বিচ্ছিন্ন থাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার সারাদেশের গড় হার থেকে পাঁচ শতাংশ বেশি। সেতুর কারণে যোগাযোগ ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হলে এই অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার প্রতিবছর ১.০১ শতাংশ হারে কমবে। এর প্রভাবে সারাদেশের দারিদ্র্য কমবে ০.৮৪ শতাংশ হারে।

তিনি গবেষণা জরিপের উদ্বৃতি দিয়ে আরও বলেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি উন্নত হওয়ার কারণে প্রতিবছর দক্ষিণ বাংলার জিডিপি বাড়বে ২.৫ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে জিডিপি বাড়বে ১.২৬ শতাংশ হারে। রেললাইন চালু হলে জিডিপিতে আরও ১ শতাংশ যুক্ত হবে।

২০১২ সালে যখন পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত হয় ড. আতিউর রহমান তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন আমাদের কাছে ছিল স্বপ্নের এক যাত্রা। এর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সম্পদে এত বড় প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি, সেই প্রমাণ দিতে পেরেছি। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক মুক্তির মহাসড়কে আর একটি মাইলফলক স্থাপন করলেন।

তিনি দৃঢ়ভাবে আশা করছেন, সেতুটি চালু হওয়ায় দক্ষিণ বাংলায় শিল্পকারখানা স্থাপনে আরও বেশি করে উৎসাহী হবেন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। তাদের যেন বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি পেতে কোনো অসুবিধা না হয়, তা এখন থেকেই সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে। উদ্যোক্তাদের পদ্মার ওপারে যেতে উৎসাহিত করতে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। করোনাকালে এসএমই খাতে যেভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছিল, সে রকম বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ দক্ষিণ বাংলার জন্য অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য নির্ধারণ করা যায় কিনা সে বিষয়টি নীতিনির্ধারকরা ভাবতে পারেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আজ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথপরিক্রমায় একটি বিশেষ দিন এবং জাতীয় আত্মমর্যাদার একটি ব্যতিক্রমী মাইলফলক। পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বাধা দূর হবে এবং একটি সমন্বিত ও একীভূত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচিত হবে, যা বাংলাদেশের শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নেরও অন্যতম পূর্বশর্ত।

তিনি বলেন, শুধু দ্রুততর যোগাযোগ, বিতরণ ও বিপণনের সুবিধার কারণে নয়, পদ্মা সেতু করিডরের উভয় পাশে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে বহুমাত্রিক প্রভাব। ইতোমধ্যে সেতু ঘিরে অ্যাপ্রোচ রোডের দুধারে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা স্থাপনার সাইনবোর্ড দৃশ্যমান হচ্ছে। সেতু কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ জেলায় ১৭টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার ও একাধিক শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। তিনি মনে করেন শুধু স্থানীয় বাজারমুখী নয়, রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপও অনেক উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে গ্রহণ করছেন। এতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নতি হবে, বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পণ্য ও সেবার সহজ চলাচলের কারণে ভোক্তা, উৎপাদক, রফতানিকারক, সেবা খাতকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আহরণের নতুন নতুন সুযোগ ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।

জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু।

তিনি মনে করেন যোগাযোগ সংযোগ, বিনিয়োগ সংযোগ ও বাণিজ্য সংযোগ এই ত্রিমুখী সংযোগের সার্থক সমন্বয় করতে সক্ষম হলে পদ্মা সেতু হবে অর্থনৈতিক করিডরের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এর আগে শনিবার বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজা সংলগ্ন উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করেন। পরে তিনি মোনাজাতে অংশ নেন।

সূত্র: বাসস

ডব্লিউজি/এএইচ

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *