পাবনার বেনারসি পল্লী এখন বন্ধের পথে, পরিত্যক্ত প্লটে সবজির চাষ

পাবনার বেনারসি পল্লী এখন বন্ধের পথে, পরিত্যক্ত প্লটে সবজির চাষ

প্রায় দুই দশক আগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাত্রা শুরু হওয়া পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লী এখন বন্ধ হওয়ার পথে। কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে পরিত্যক্ত প্লটের জমিতে অনেকেই সবজির আবাদ করছেন।

বেনারসি পল্লীর ব্যবসায়ী ও কারিগরদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য থাকলেও এখন সেখানে সুনসান নীরবতা। ঘাস, জঙ্গল আগাছায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা।

পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে বৈধ আর অবৈধ পথে আসা (পাওয়ার লুম) মেশিনে তৈরি শাড়িতে বাজার দখল হওয়ায় (হ্যান্ড লুম) হাতে তৈরি দেশি বেনারসি শাড়ি বাজার হারাতে বসেছে। তাই পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লীতে এখন শাড়ি তৈরির কারখানা গুটিয়ে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বেনারসি পল্লী এলাকায় প্রবেশ করলেই প্রথমেই চোখে পড়বে জরাজীর্ণ প্রশাসনিক ভবন। এর ঠিক পেছেনে তাঁত ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দকৃত সারি সারি প্লট।

আবাসনসহ কারখানা নির্মাণের জন্য প্রাপ্তস্থানে অনেকেই ঘর ও কারখানা নির্মাণ করেছিলেন। হাতে তৈরিকৃত (হ্যান্ডলুম) মেশিন বসিয়ে শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। তবে সেটি খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি তাঁত ব্যবসায়ীরা। উৎপাদন খরচের সঙ্গে পণ্যের বাজার মূল্য না পাওয়াতে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তাদের।

সরকারিভাবে নানা সময়ে আর্থিক সহযোগিতা করা হলেও উঠে দাঁড়াতে পারছেনা তারা। পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে আসা (পাওয়ার লুম) মেশিনে তৈরি শাড়ি বাজারে কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। আর হাতে তৈরি দেশি বেনারসি শাড়ির মূল্য পড়ছে অনেক বেশি।

তাই অভিজাত পণ্য বেনারসি শাড়ি কিনতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন ক্রেতারা। এর প্রভাবে এ পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে গেছেন বেশিরভাগ তাঁত শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে অনেক মানুষ এখানে কাজ করতো। আগে পরিবেশটা বেশ সুন্দর ছিল। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা কারখানা করে শাড়ি তৈরি করতো এখানে।

তবে উৎপাদন খরচের সঙ্গে সঠিক দাম না পাওয়ায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। মালিকরা টাকা খরচ করে শাড়ি তৈরি করে সেটা বিক্রি করতে পারছেন না। শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়ে থাকছে। তাই শ্রমিকেরা এ কাজ ছেড়ে অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

সর্বশেষ আপডেট পেতে ভিজিট করুন https://worldglobal24.com/

তাঁত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ কাজ করে নিজেদের সংসার চলছে না। যে কাজ করে সংসার চলে না সে কাজ কেউ করতে চায় না। কারিগরদের কাজ না থাকায় সবাই বেতন বকেয়া থাকায় চলে গেছেন অন্যত্র।
মহাজনদের দোষ দিয়ে কি হবে বলেন। কাপড় বিক্রি থাকলে কারখানা চলতো। ইন্ডিয়ান শাড়ি বিক্রি হওয়ার কারণে দেশি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে না। এখন তাঁতের কারিগর নেই বললেই চলে। কারখানা বন্ধ করে সবাই চলে গেছেন এখান থেকে। দেশের তাঁত শিল্পকে ধ্বংস করে দিল কিছু চোরাকারবারি।

তাঁত শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা বলেন, ভারতের মাল বাজারে আসায় এখন ব্যবসা চলে না। আগে অনেকগুলো কারখানা ছিল। এখন কারখানা চালু করতে হলে শ্রমিক দরকার টাকা দরকার। পরিস্থিতি খুব খারাপ, খেয়ে না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা হয়েছে আমাদের।

নানা সমস্যার মধ্যে এ জঙ্গলের মধ্যে থাকতে হয় আমাদের। এখানে আমরা যারা রয়েছি তাদের ভিনদেশি বলে সমিতি ব্যাংক লোন দেওয়া হয় না। আমরা চাই এ তাঁত আবার চালু হোক। বাইরের শাড়ি আসায় এ ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেছে। করোনার সময়ে এ ব্যবসা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয় বেনারসী শাড়ির ব্যবসায়ীরা বলেন, এখন ব্যবসা খুব কষ্ট করে করতে হচ্ছে আমাদের। বর্তমানে এ অঞ্চলে তাঁত বন্ধের পথে। কয়েকটা মহাজন মিলে তাঁত চলাতে হচ্ছে। সরকার এখানে পল্লী দিয়েছে কিন্তু তাঁতীদের সেই সামর্থ নেই যে সেখানে কিছু করবে।

বিদেশের পাওয়ারলুম শাড়ি আর আমাদের হ্যান্ডলুমের শাড়ি। পাওয়ারলুম মেশিন দিয়ে যদি আমরা শাড়ি তৈরি করতে পারি তবে বাইরের থেকে ভালো শাড়ি তৈরি করতে পারবো আমরা। এ জন্য সরকারের আর্থিক সহযোগিতা দরকার।

ঈশ্বরদী বেনারসী পল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহ-জামান বলেন, সরকারিভাবে এখানে তাঁতীদের জন্য নব্বইটি প্লট করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। শর্তপূরণ না করায় ১৪টি প্লটের বরাদ্দ এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে। আগে বেশ কিছু কারখানা ছিল এখানে।

এখন তিনটি কারখানায় কাজ চলছে। আর অন্য কারখানা বন্ধ করে দিয়েছের মালিকরা। পার্শ্ববর্তী ভারতের শাড়ি দেশের বাজারে কম দামে বিক্রি হওয়া ও দেশি হাতে তৈরি বেনারসী শাড়ির দাম বেশি হওয়াতে এ ব্যবসায় মন্দা লেগেছে।

তবে শাড়ি তৈরির সনাতন পদ্ধতি পবিবর্তন করে আধুনিক পদ্ধতিতে শাড়ি তৈরি করে কম দামে বিক্রি হলে হয়তো তাঁত শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

ঈশ্বরদী পৌর এলাকার ফতে মোহাম্মদপুরে প্রায় পাঁচ একর জায়গায় ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করে বেনারসি পল্লী। ৫ শতাংশ জায়গাতে ২০টি ও ৩ শতাংশ জায়গা নিয়ে ৭০টি মোট নব্বইটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।

কিন্তু জমি বরাদ্দের শর্ত পূরণ না করায় এরই মধ্যে ১৪ জনের বরাদ্দ বাতিল করেছে তাঁত বোর্ড। প্রথম দিকে প্রায় ৪০টি ছোট বড় কারখানায় তৈরি হতো বেনারসি শাড়ি। শুরুতে অনেকেই নতুন উদ্যোমে এ পল্লী এলাকাতে বেনারসি শাড়ি উৎপাদন কাজ শুরু করলেও সেটি বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি।

পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে আমদানিকৃত পাওয়ার লুম মেশিনে তৈরি বেনারসি শাড়ি বাজার দখলের কারণে দেশে উৎপাদিত হাতে তৈরি বেনারসি শাড়ি কদর কমে গেছে ক্রেতাদের কাছে। শত বছরের দেশি ঐতিহ্যের অংশ অভিজাত পণ্য বেনারসি শাড়ি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।

 

শেয়ার করুন:

Recommended For You