শতবছরে জয়পুরহাটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তেঘর উচ্চ বিদ্যালয়

শতবছরে জয়পুরহাটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তেঘর উচ্চ বিদ্যালয়
শতবছরে পদার্পণ করেছে  জয়পুরহাট সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান  তেঘর উচ্চ বিদ্যালয়। মাধ্যমিক এই বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক ইতিহাস রয়েছে। শুরুতে মক্তব তারপর জুনিয়র  মাদ্রাসা।  সেখান থেকে হাই মাদ্রাসা নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও পরে সরকারি এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে হাইস্কুলে রুপান্তর করা হয়। শত বছরে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব জায়গায় সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে পুরোনো অনেক জানা অজানা স্মৃতি । নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ও কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তেমনি এক শতবর্ষী স্কুলের নাম তেঘর উচ্চ বিদ্যালয়।
এই বিদ্যালয়টি বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ইতিহাসের তিন অধ্যায়ের স্বাক্ষী হিসেবে এখনও বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শৈশব, কৈশর ও যৌবন পেরিয়ে, বাধ্যক্যে উপনিত হয়ে আবার নবযৌবনা লাভ করেছে এ বিদ্যালয়। এস.এস.সি পরীক্ষায় শতভাগ পাশের রেকর্ড গড়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে সাফল্যতার শিখর পানে। সুবিশাল মাঠ, সুরক্ষিত ও দৃষ্টিনন্দন বিদ্যালয় ভবন এবং মনমুগ্ধকর পরিবেশ এই বিদ্যালয় সকলে মুগ্ধ করে।
তেঘর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে জানা যায় আজ থেকে শত বর্ষ পূর্বে উত্তর বঙ্গের বগুড়া জেলার অন্তর্গত জয়পুরহাট রেল ষ্টেশনের অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিনে যে গ্রামের সূচনা হয়েছে তখন সে গ্রামের নাম ছিল তেঘরী বিশা। বাংলা ১৩৩১ সনের ১৬ শ্রাবন (ইং ১৯২৪) সালে অত্র গ্রামের একজন শিক্ষানুরাগী মুহাম্মদ ফুলমিয়া মন্ডলের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় এলাকার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি জনাব নবী বকশ মন্ডলের বাড়িতে মিলিত হন। তারা দুজন ছাড়াও অপর ব্যক্তিগন হলেন- মুমিন উদ্দিন মন্ডল, সাদার বকশ, কছির উদ্দিন ও আছিরা মন্ডল। তারা এ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন সে, যেহেতু গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম কিন্তু কোন শিক্ষা প্রতিষ্টান না থাকায় তারা যেমন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে  তেমনই নানা কুসংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সুতরাং তাদেরকে ধর্মীয় জ্ঞানে উদ্ভসিত করা অতীব জরুরী। সে জন্য একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা দরকার এবং তা প্রতিষ্ঠার পাকা সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন। মাদারাসা গৃহ নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত  মাদার বকশ সরদারের বহির্বাষ্টিতে লেখাপড়া কার্যক্রম পরিচালনা শুরুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আরবী ও বাংলায় পারদর্শী একজন মাত্র শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। তাঁর নাম ছিল মৌলবী তাজ উদ্দীন। ফুলমিয়া মন্ডলকে সেক্রেটারী করে ৬ সদস্যর মাদরাসা পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। খরচাদি নির্বাহের জন্য এলাকাবাসীর নিকট থেকে সাপ্তাহিক মুষ্টির চাল আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সর্বশেষ আপডেট পেতে ভিজিট করুন https://worldglobal24.com/

অনুষ্ঠানিক লেখাপাড়া শুরুর জন্য মাদারাসাগৃহ নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হলে একজন হৃদয়বান ব্যক্তি  আঃ লতিফ রেজিষ্ট্রি মূলে ১৫ কাঠা জমি দান করেন। বলা বাহুল্য তিনিই বিদ্যালয়ের প্রথম জমি দাতা। সেই জমিরি উপর দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট একটি পাকাগৃহ নির্মাণ করা হয় এবং মাদারাসার নাম রাখা হয় তেঘরি বিশা ইসলামিয়া জুনিয়র মাদারাসা। তখন জয়পুরহাটে কোন শহর ছিলো না। সেজন্য এখানে কোন ব্যাংকও ছিল না। তবে পোষ্ট অফিস ছিল এবং তাতে একাউন্ট খোলা যেত। মাদারাসার আয় নিরাপদে জমা রাখার জন্য উক্ত পোষ্ট অফিসে ১৯২৭ সালে একটি একাউন্ট খোলা হয়। একাউন্ট নাম্বার ছিল ১৯৩০২।
মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ৪ বছর পর ১৯২৮ সালে অত্র মাদারাসার শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় জুনিয়ার পরীক্ষায় আংশগ্রহণ করে এবং কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। ১৯৩২ সালে মাদারাসার তদানিন্তন সেক্রেটারী জাকের উদ্দীন মন্ডল ও সভাপতি মুমিন উদ্দীন মন্ডল শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য রেললাইন সংলগ্ন বিশাল মাঠ দান করেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে শ্রেণি সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। সে জন্য ১৯৩৮ সালে জুনিয়ার মাদারাসাকে সিনিয়ার মাদরাসা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিশাল খেলার মাঠের পশ্চিম প্রান্তে ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৫ ফুট প্রস্থের ১১ কক্ষ বিশিষ্ঠ (E) আকৃতি বিরাট পরিসরের মাটির মাদারাসা গৃহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ৮৫০ টাকার বিনিময়ে গৃহ নির্মানের ঠিকাদারী নেন হাজী সবুজ মন্ডল নামের একজন মাদারাসা হিতৈষী।১৯৩৯ সালের মধ্যে উক্ত মাদারাসা সহ নির্মাণ সম্পন্ন হয়। দূর দূরান্ত থেকে আগত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকগণের জন্য মাঠের উত্তর প্রান্তে L আকৃতির পাকা আবাসিক হোটেল নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৩ সালে অত্র মাদারাসা হাই মাদ্রাসা হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে। তখন এ মাদ্রাসা বোর্ডের অধিন ছিল।১৯৬০ সালে এক সরকারী অধ্যাদেশের ফলে তেঘর হাই মাদরাসা “তেঘর হাই স্কুল” এ রূপান্তরিত হয়। সেই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত  ঐতিহ্যবাহী তেঘর উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার আলো ছরিয়ে আসছে।
বিদ্যালয়ের কিছু সাফল্য ১৯৫৭ সালের মেট্রিকুলেশান পরীক্ষায় অত্র হাই মাদারাসা থেকে মাত্র একজন শিক্ষার্থী ফাস্ট ক্লাস পায়, তবে ঢাকা বোর্ডেও মেধা তালিকায় তিনি ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন তার নাম মোঃ শামসুল আলম।১৯৫৯ সালের পরীক্ষায় ও একজন মাত্র শিক্ষার্থী ফাস্টক্লাস পায়। তিনিও বোর্ডেও মেধা তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন তার নাম মোঃ মোখলেছার রহমান।
এ বিদ্যালয় থেকে অনেক শিক্ষার্থী দেশের স্বনামধন্য জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নূরুল ইসলাম (রংপুর), সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সরদার এমদান হোসেন (রাজশাহী), দেশ বরেন্য ডাঃ গোলাম মওলা চৌধুরী এবং অধ্যাপক ডাঃ মুজিবুর রহমান এবং উর্ধতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হাইউল কাইয়ুম তারাও এই স্কুলের ছাত্র ছিলে।জয়পুরহাটের সর্ববৃহৎ খেলার মাঠ সুবাদে এ বিদ্যালয় থেকে তৈরী হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে অনেক ক্রীড়াবিদ। এ মাঠের ধুলো পদ যুগলে মেখে ধন্য হতে ছুটে এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নামকরা খেলোয়ারা। তারা প্রদর্শন করেছেন অসাধাররণ ক্রীড়ানৈপণ্য আনন্দে উদ্বোলিত করেছেন অযত দর্শককে। তাদরে একজন আফজাল হোসেন।
স্কুলের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, আসন্ন ২৬ ডিসেম্বর-২০২৪, ঐতিহ্যবাহী তেঘর উচ্চ বিদ্যালয়-জয়পুরহাট সদর এর শতবর্ষ পূতি উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ অনুষ্ঠান সফল করার জন্য অত্র বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রগণ প্রানান্তকর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শিক্ষকমন্ডলী এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সর্বোতভাবে সহযোগীতা করছেন।  আমরা একান্তভাবে আশা করছি- ১৯২8 থেকে আজ পর্যন্ত যারা এইস্কুলে একদিনের জন্যও লেখাপড়া করেছেন এবং যারা শিক্ষকতা করেছেন তাঁরা শতবর্ষের এই শিক্ষার্থাীদের  মহা মিলন মেলায় যোগ দিয়ে বন্ধু বান্ধবদেরকে আনন্দিত করবেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
স্কুলের  সহকারী  প্রধান শিক্ষক মমিনুর রহমান  জানান, এখন বিদ্যালয়ে প্রায় ৩শ ৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শতবর্ষী এ বিদ্যালয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরিতে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ,  দেশের স্বনামধন্য জায়গায় চাকুরী ও প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ  করছেন।  এ ছাড়া বেশ কিছু খ্যাতিমান চিকিৎসক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছেন। বর্তমানে শিক্ষকদের দূরদর্শিতা ও শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলের মধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে  বিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠান কে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
স্কুলের সাবেক সভাপতি ও শতবর্ষ উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ ইকবাল বলেন, মানুষ গড়ার এই বিদ্যাপীঠ সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই স্কুলে টি আমার কাছে আবেগ এবং স্মৃতির একটি জায়গা। স্কুলটি যেন শতবছর আমাদের মাঝে টিকে থাকে এবং ভালো ফলাফল করে সারা দেশের মধ্যে যেন স্কুলের  স্বনাম বয়ে আনতে পারে এই প্রত্যাশা করি।
স্কুলের সাবেক ছাত্র  ও শতবর্ষ উদযাপন কমিটির সভাপতি গোলজার হোসেন  বলেন, জয়পুরহাট জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তেঘর স্কুল।২০২৪ সালে  আমাদের স্কুলের  শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এই স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে গৌরবময় কীর্তির স্বাক্ষর রেখে চলেছে। আমরা অনেক সৌভাগ্যবান যে আমরা শতবর্ষ আয়োজন অংশ গ্রহণ করতে পারছি।সকলের সহযোগিতায় আমরা যেন শতবর্ষ উদযাপন সফলভাবে সম্পুর্ণ করতে পারি।  বিদ্যালয়ের হাজার হাজার বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী রয়েছে। সকলকে নিয়ে  জমকালো আয়োজনে দিনব্যাপী শতবর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজন করা হচ্ছে।
শেয়ার করুন:

Recommended For You