মাতারবাড়ির বিচারাধীন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোল কোম্পানি

মাতারবাড়ির বিচারাধীন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোল কোম্পানি

# কয়লার দাম চড়া হলেও আগ্রহ আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামে
# তিন বছরে আমদানি হবে ৯.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা
# আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তেই চলছে কোল কোম্পানি
# নসরুল হামিদের সিন্ডিকেটেই যাচ্ছে টন প্রতি ৫ ডলার কমিশন

বিচারাধীন বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেয়া না গেলেও মাতারবাড়ি প্রকল্প অনিয়মে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই ‘জ্বালানি ঘাটতি’ অজুহাতে একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামকে কার্যাদেশ দেয়ার চেষ্টা করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (সিপিজিসিবিএল)। বরাবরের মত চড়া মূল্যে আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামককে তিন বছর মেয়াদি কার্যাদেশ প্রদান করার চেষ্টা চলছে বলে প্রকল্পের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

গত ৭ জুলাই হাইকোর্টে রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদান করে দরপত্রের পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত করে আদালত।গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সিপিজিসিবিএলের কিছু দূর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তারা ব্যাক্তিগত সুবিধা নেয়ার জন্য বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত পরিপালন করছেন বলে জানা গেছে। ভারতীয় কোম্পানি আদিত্য বিড়ালাকে সুবিধা দেয়ার স্বার্থে। আর এই কাজটি করেন সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক এলাহি চৌধুরী, সাবেক মূখ্য সচিব লোকমান হোসেন মিয়া, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান, সাবেক পিডিবি চেয়ারম্যান মাহাবুবুর রহমান এবং সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদের সিন্ডিকেট এখনও সক্রিয় প্রকল্পে। টন প্রতি ৫ ডলার কমিশন বাণিজ্যই এদের উদ্দেশ্য।

দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে দেশীয় একটি কনসোর্টিয়াম পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি বরবার রিভিউ আবেদন করে।

হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়াম আপীল দায়ের করিলে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের তৎকালীন মাননীয় চেম্বার জজ বিচারপতি এনায়েতুর রহিম গত ২৫ জুলাই হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ স্থগিত করে রীট পিটিশনটি আগামী ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ প্রদান করেন।

গত ০৫ সেপ্টেম্বর কিছু পর্যবেক্ষনসহ রিট পিটিশনটি ‘ডিসপোজাল’ করা হয়, দেশীয় কনসোর্টিয়াম-এর পক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট মামুন চৌধুরী ও ব্যারিস্টার সুহান খান। আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়াম এর পক্ষে শুনানি করেন সাবেক অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও সিপিজিসিবিএল-এর পক্ষে শুনানি করেন বর্তমান অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল অনিক আর হক।

সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ পেতে ভিজিট করুন https://worldglobal24.com/latest/

জানা গেছে, গত বছর ১৫ নভেম্বর কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ সিপিজিসিবিএল) মাতারবাড়ি পাওয়ার প্ল্যান্টে ৩ বছর ব্যাপী ৯.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে।

মাতারবাড়ি প্রকল্পের অনিয়ম প্রসঙ্গে, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এম শামসুল আলম বলেন, মাতারবাড়িসহ জ্বালানিখাতে যেসকল অনিয়ম প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে, তার সঠিক বিচার না করে শুধুমাত্র বোর্ড চেঞ্জ করলে সুফল আসবে না।

তিনি বলেন,জণগনের টাকায় বড় বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে লুটপাটের জন্য, এখন সময় এসেছে তার বিচার করার, সেটা না হলে আগামীতে আরো দূর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে।

প্রকল্প কর্মকর্তাসহ যারা দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুবিধা নিয়েছেন, সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর আলম।

মাতারবাড়ি প্রকল্পের দূর্নীতি বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাধারণ অবস্থায় আদালতে মামলাধীন কোন বিষয়ে সরকার এমনটা করতে পারে না।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সেখানে আপীল করতে পারে, আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সাপেক্ষে এটা করা উচিৎ। আবার জরুরী বিবেচনায় সরকার যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পার। তবে সেটা যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে হবে। শর্টকাট পদ্ধতি বা বিশেষ কোন কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে, তার পিছনে কি যুক্তি আছে, তা সুস্পষ্টভাবে জনস্বার্থে প্রকাশ করতে হবে।

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, আদালতে যেহেতু এটা বিচারাধীন আছে, তাই পুরো প্রকিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। আদালতে যেহেতু বিচারাধীন ফলে পুরো প্রকিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ এবং সেই কারণেই বিচারাধীন। বিচারাধীন সত্ত্বেও জনস্বার্থে যদি কোন সিদ্ধান্ত অপরিহার্য বলে মনে করে, তাহলে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সাপেক্ষে করা উচিৎ, অন্যথায় সরকারের সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হবে, সরকার নিজে থেকেই বিব্রত হবে। যেটা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশিত নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকল্প কর্মকর্তা বলেন, ব্যাক্তিগত ভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের প্রায় ১০৬৭ কোটি টাকা বেশি ব্যয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি করে দুর্নীতিমূলক, চক্রান্তমূলক ও প্রতিযোগিতাহীন একটি দরপত্রের দ্বারা আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়ামকে কার্যাদেশ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা। জানা গেছে, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি বিধান লঙ্ঘন করে আদিত্য বিড়ালা কনসোর্টিয়াম বরাবরে ৩ বছর ব্যাপী ৯.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহের কার্যাদেশ প্রদান করার চেষ্টা করছেন যা সুস্পষ্ট রূপে দুর্নীতি মূলক কার্যক্রম।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিপিজিসিবিএলের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এতে দেখা যায়, অবৈধভাবে ১৬টি কাজে ১০৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার ভেরিয়েশন প্রদান, প্রকল্পের টাউনশিপ এলাকায় বালু ভরাটের নামে ৬৮ কোটি টাকা, বিটুমিন বা পিচের সড়ক না করে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করে ২৫৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, সিপিজিসিবিএলের নিজস্ব স্ক্র্যাপ বিনা নিলামে বিক্রির মাধ্যমে ৫৩ কোটি টাকা, ইনস্টিউশনাল ডেভেলপমেন্টের নামে ১২ কোটি টাকা, প্রকল্পের ঠিকাদারের লেফটওভার ম্যাটেরিয়াল বিক্রির মাধ্যমে ২৬ কোটি টাকা ছাড়াও বিভিন্ন মূল্যবান মালামালের কান্ট্রি অব অরিজিন পরিবর্তন করে এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে প্রকল্পে নিন্মমানের মালামাল সরবরাহ করা হয়।

 

শেয়ার করুন:

Recommended For You