প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয় আফনান পাটওয়ারী। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলায় প্রাণ যায় তার। এ ঘটনায় মামলা করে আসামিদের হুমকি-ধামকির ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আফনানের মা নাছিমা আক্তার ও বোন জান্নাতুল মাওয়া।
ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং একপর্যায়ে গুলি চালায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা। পরে এক সহপাঠীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় আফনান। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি সে, চলে যায় না ফেরার দেশে।
এমন মৃত্যু মানতে পারছে না তার সহপাঠী ও আন্দোলনরত অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। আফনানের শোকে আহাজারি যেন থামছেই না তার মা ও বোনের।
এদিকে ১৪ আগস্ট রাতে আফনানের মা নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে এ ঘটনায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুকে প্রধান আসামি করে ৭৫ জনের নামে মামলা করেন। তাতে অজ্ঞাত আরও ৫০০-৭০০ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু মামলার আসামিরা আত্মগোপনে থেকে বিভিন্নভাবে তাদের হুমকি ধমকি দিচ্ছেন। এতে ভয়ে বাসায় তালা দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আফনানের মা নাছিমা ও বোন জান্নাতুল মাওয়া।
ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় কথা হয় আফনানের মা ও বোনের সঙ্গে। আফনানের মা নাছিমা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ৩ মাস আগে আমার স্বামী সালেহ আহমদ বিদেশে মারা গেছেন। সেই শোক না কাটিয়ে উঠতেই আবার ছেলেকে হারালাম। তারা (সন্ত্রাসীরা) আমার মেধাবী ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমরা মামলা করেছি। এখন বিভিন্ন মোবাইল ফোন নাম্বার থেকে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কার কাছে যাব আমরা। ছেলের জন্য সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবি জানান তিনি। তাদের দেখার মতো আর কেউ নেই বলেই অচেতন হয়ে পড়েন নাছিমা।
সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ পেতে ভিজিট করুন https://worldglobal24.com/latest/
আফনানের বোন জান্নাতুল মাওয়া তার মাকে আগলে ধরে বলেন, আদরের ভাইকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। ৩ মাসের ব্যবধানে বাবা ও ভাইকে হারিয়েছি। স্মৃতি হিসেবে আছে শুধু আফনানের সাইকেল। তবে সরকারের কাছে ভাই হত্যার কঠোর বিচার দাবি জানান তিনি।
লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে আফনানের সহপাঠীরা জানায়, প্রাইভেট পড়তে গিয়ে বই খাতার ব্যাগ কাঁধে নিয়েই আন্দোলনে যায় আফনান। হঠাৎ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে হামলা করে। সহপাঠী এক শিক্ষার্থীকে (ছাত্রী) বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় আফনান। একপর্যায়ে সে মাদাম ব্রিজের ওপর লুটিয়ে পড়ে সে। পরে তাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে আফনানের মৃত্যু হয়।
নিহত আফনান লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার আরমানি মিঝি মসজিদ বাড়ির বাসিন্দা ছিল।
আফনান হত্যায় এজাহারভুক্ত বাকি ৭৪ জন আসামিরা হলেন- জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম রকি, সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া, জেলা কৃষকলীগের সদস্য সচিব ও বাঙ্গাখাঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ভূঁইয়া, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি চৌধুরী মাহমুদুন্নবী সোহেল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন লোটাস, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সেবাব নেওয়াজ, লাহারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাইফুল হাসান পলাশ, সাবেক আলোচিত মেয়র প্রয়াত আবু তাহেরের বড় ছেলে আফতাব উদ্দিন বিপ্লব, ছোট ছেলে আনোয়ার সাদাত শিবলু, লক্ষ্মীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আহম্মদ পাটওয়ারী, জেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক ইউছুফ পাটওয়ারী, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব ইমতিয়াজ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা তানভীর হায়দার চৌধুরী রিংকু, আওয়ামী লীগ নেতা জালাল উদ্দিন রুমি, মান্দারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন রুবেল পাটওয়ারী, জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম-আহবায়ক বায়েজীদ ভূঁইয়া, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল করিম নিশান, রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাকী বিল্লাহ ও জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিন আলম।
প্রসঙ্গত, ৪ আগস্ট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গিয়ে লক্ষ্মীপুরের মাদাম ব্রিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আফনান। ১৪ আগস্ট রাতে আফনানের মা নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ৭০০ জনকে আসামি করে সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুকে প্রধান আসামি করা হয়। টিপু ও জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিন আলমের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।