কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুম ও বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবকে হেফাজতে নেওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তার দাবি, নিরাপত্তার স্বার্থে নুসরাত, আসিফসহ পাঁচজনকে ডিবির হেফাজতে আনা হয়েছে। তাদের পরিবারকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তবে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলের কোনো সন্ধান মেলেনি। এর আগে গতকাল ভোরে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল ও নুসরাত তাবাসসুমকে ভোরে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। অবিলম্বে তাদের সন্ধান ও মুক্তি চাই।’ নুসরাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন
গতকাল ভোর ৫টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় তাকে। অন্যদিকে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফকে শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন তার বাবা শাহাবুর রহমান। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে শনিবার সন্ধ্যায় হেফাজতে নেয় ডিবি পুলিশ। তারও আগে শুক্রবার বিকালে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদেরও নিরাপত্তার কারণে হেফাজতে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। ডিবির হেফাজতে থাকা এই পাঁচ সমন্বয়কই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সাত সমন্বয়ককে তুলে আনার বিষয়ে হারুন অর রশীদ বলেছেন, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন লাগিয়েছে, এসব দুর্বৃত্ত ও জামায়াত-শিবিরের চক্রদের ধরার দায়িত্ব আমাদের। কেউ যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তারা যদি বিভিন্ন জায়গায় বলে, তাদের সঙ্গে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে, এটা জানার পর আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাদের নিরাপদে নিয়ে আসা। তিনি বলেন, প্রশ্ন আসতে পারে শুধু তাদের ক্ষেত্রে কেন নিরাপত্তার বিষয়।
মনে রাখতে হবে- এই লোকগুলোকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘিরেই কিন্তু অসাধু চক্র জামায়াত-বিএনপি অনুপ্রবেশ করে একটা গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল। এই চক্র রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আগুন লাগাতে চেয়েছিল। সেই কারণে আমি মনে করি, এই চক্র যদি আবার শিক্ষার্থীদের কোনো কিছু করে আন্দোলনের কিছু করতে চায়, সেই জন্য নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নিয়েছি। কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে কত দিন রাখা হবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা সমন্বয়কদের সঙ্গে কথা বলব এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলব। নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি সমন্বয়কদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে হারুন-অর-রশিদ বলেন, তারা নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের কাছে। তার পরও তাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে কথা-বার্তা হচ্ছে। আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সুন্দর একটা আন্দোলন ছিল। এই আন্দোলনের সময় তাদের সঙ্গে কারা কারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কারা কারা তাদের উসকানি দিয়েছিল। আমরা তাদের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারা কিছু নাম ও নম্বর আমাদের দিয়েছে। খবর ছড়ানো হচ্ছে যে, ডিবিতে সমন্বয়কদের মারধর করা হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, যারা ফেসবুকে লেখালিখি করে, তারা অনেকের নাম-নম্বর ধরে বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছে। আমি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেছি- এই গুজবও ছড়িয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রের অনেক ব্যক্তির নামেও কিন্তু অনেক গুজব ছড়িয়েছে। তাহলে এটাও বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আমরা যাদের নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়ে এসেছি, তাদের নিয়ে যদি কোনো গুজব ছড়ায়, সেটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তারা এই গুজব ছড়িয়ে কিছু ভিউ বাড়িয়ে টাকা আয় করতে চায়। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন আসছে আন্দোলনকারীদের পুলিশ ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, যাতে করে তারা আর একত্রিত হতে না পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, এসব গুজবকে আপনারা বিশ্বাস করবেন না। আইনের স্বার্থে আমরা অনেককে অনেক সময় গ্রেপ্তার করেছি। যারা পুলিশকে হত্যা করেছে এবং গত ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির… সেই সময় তো ওইসব ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তার করেছিলাম। সেই সময়তো প্রশ্ন আসেনি যে, আমরা তাদের প্রতি অন্যায় করেছি। আজকে যে মানুষকে আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়ে এসেছি… এই গুজব আপনারা বিশ্বাস করবেন না। সমন্বয়কদের পরিবারের পক্ষ থেকে ও তাদের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, নিরাপত্তা পরিবারের মাধ্যমে যেন দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান বলেন, কারা কী বলছে এ বিষয়ে আমরা কোনো কিছু জানি না। আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো আবেদন আসেনি। আমাদের কাছে এই বিষয়ে কেউ কিছু বলেনি। আমরা জাস্ট নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নিয়ে এসেছি। তাদের আন্দোলন সম্পর্কে টুকটাক আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তিনি বলেন, যাদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা নিয়ে এসেছি, তাদের পরিবারের কাছে অনুরোধ করব, দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমরা মনে করি তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা দেখছি। তাদের পরিবার যেন নিশ্চিন্ত থাকে, সেই বিষয়ে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই।
আরিফ সোহেলের সন্ধান মেলেনি :
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী ও কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল ভোর ৪টার দিকে আরিফ সোহেলকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আমবাগান এলাকার বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার ছোটবোন উম্মে খায়ের ঈদি।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব। তার দাবি, জাবি কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোনো নেতাকে তুলে আনা হয়নি।’ জানা গেছে, আরিফ সোহেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের (৪৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী। তিনি তার পরিবারের সঙ্গে আমবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। আরিফের বোন ঈদি বলেন, ঠিক রাত ৩টা ৫০ মিনিটে সাদা পোশাকে ৮ থেকে ১০ জন আমাদের বাসার নিচে এসে ডাকাডাকি শুরু করেন।
আমার বাবা তাদের পরিচয় জানতে চান। তারা পরিচয়পত্র দেখিয়ে ডিবি পরিচয় দেন। আমরা দরজা খুলতে না চাইলে তারা দরজা ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। দরজা খুলে দিলে তারা ভিতরে এসে সবার ফোন নিয়ে নেন। এ সময় তারা ভাইয়ের কম্পিউটার চালু করে কিছু ছবি নেন। পরে আশুলিয়া থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আরিফ ও আমার বড় ভাইকে একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। তবে তারা আমার বড় ভাইকে সাভারের গেন্ডা এলাকায় ছেড়ে দেন। এর পর থেকে আরিফের খোঁজ পাচ্ছি না।