বেনজীরের বিপুল অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

বেনজীরের বিপুল অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের (তিন মেয়ে) নামে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি তাঁদের কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ার কথাও উচ্চ আদালতকে জানিয়েছে সংস্থাটি।

বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল রবিবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। আজ সোমবার প্রতিবেদনটি বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপনের পর শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। সুপ্রিম কোর্টের এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা ও এক মেয়ের বিরুদ্ধে একটি ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অগ্রগতি প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে। সোমবার শুনানি হতে পারে।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ১৭(গ) ধারা অনুসারে, কমিশন কোনো অভিযোগে স্ব-উদ্যোগে অনুসন্ধান শুরু করতে পারে। কিন্তু বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে পর পর দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পরও কমিশন অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়নি, যে কারণে গত ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। এতে কাজ না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল বিবাদীদের আইনি নোটিশ দেন তিনি। নোটিশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে স্ব-উদ্যোগে অনুসন্ধানের অনুরোধ করা হয়। সাড়া না পেয়ে গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রিটে বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করেন তিনি।

ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন

দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনের তদন্ত ও অনুসন্ধান বিভাগের দুই কমিশনার ও দুদক সচিবকে বিবাদী করা হয় রিটে। সেই রিট গত ২৩ এপ্রিল শুনানিতে ওঠে। শুনানিতে দুদকের আইনজীবী আদালতকে জানান, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ২২ এপ্রিল তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। ওই টিম অনুসন্ধান শুরু করেছে। পরে আদালত রিটের ওপর রুল জারি না করে অনুসন্ধানকাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন চান। দুই মাসের মধ্যে এ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় হাইকোর্টে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিল দুদক।

৪৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫২ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ 

বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে অগ্রগতি প্রতিবেদনে। আর অভিযোগসংশ্লিষ্ট সম্পদের তথ্য চেয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শকের কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (বিএফআইইউ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সরকারি-বেসরকারি ৪৬টি দপ্তরে চিঠি দেওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, প্রায় সব দপ্তর থেকে রেকর্ডপত্র পাওয়া গেছে। এসব রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্থাবর সম্পদের মধ্যে ঢাকা জেলা, ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, কক্সবাজার ও খুলনায় বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা ও তাঁদের তিন মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের মালিকানাধীন জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, রিসোর্ট ও বাংলো রয়েছে।

তাঁদের ১১৬টি ব্যাংক হিসাবের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। এছাড়া জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধিত পূর্ণ ও আংশিক মালিকানাধীন একাধিক কম্পানির তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোতে তাঁদের কোটি কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ নিবন্ধিত একাধিক ব্রোকারেজ হাউসে তাঁদের নামে বেশ কয়েকটি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট এবং সেসব অ্যাকাউন্টে লেনদেনর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ঢাকায় কমিউনিটি ব্যাংকের করপোরেট শাখা থেকে বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা ও মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের অস্বাভাবিক লেনদেনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর (২৩, ২৪ ও ২৯ এপ্রিল) দ্রুত সময়ে সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ (ছয় কোটি ৫২ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৮ টাকা) অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৯ এপ্রিল ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে আউটার ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তিন কোটি, ৩০ এপ্রিল তিন কোটি সাত লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। একই দিনে (৩০ এপ্রিল) সাভানা ফার্ম প্রডাক্টস নামের একটি চলতি হিসাব থেকে ১৪ লাখ টাকা উত্তোলন করেন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা।

প্রতিবেদনে স্থাবর সম্পদ জব্দ, অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ ও দেখভালের জন্য রিসিভার নিয়োগের ফিরিস্তি, আদালতের আদেশ ও তারিখ তুলে ধরে অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগসংশ্লিষ্ট বক্তব্য জানতে বেনজীর আহমেদকে গত ৬ জুন ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেননি, যে কারণে ২৩ জুন তাঁকে ফের ডাকা হয়। সেদিনও তিনি আসেননি। এছাড়া স্ত্রী জীশান মীর্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের বক্তব্য জানতে গত ৯ জুন ডাকা হয়েছিল। ওই দিন না আসায় ২৪ জুন তাঁদের আবার ডাকা হয়। সেদিনও তাঁরা আসেননি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড ও তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে বেনজীর আহমেদের নামে মোট ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৬৫ টাকা, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে ২১ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩ টাকা, বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের নামে আট কোটি ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৬ টাকা, মেজো মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে চার কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এছাড়া বেনজীর আহমেদের নামে বান্দরবানের সদর উপজেলায় ২৫ একর লিজ (ইজারা) জমি, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের দোশরপাড়া ও বালুচর মৌজার ধলেশ্বরী সমবায় সমিতি লিমিটেডে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে একটি করে মোট দুটি প্লট (জমির পরিমাণ ১৪ কাঠা) রয়েছে। ঢাকায় উত্তরা আবাসিক এলাকায় জীশান মীর্জার নামে তিন কাঠা জমি এবং ওই জমির ওপর সাততলা বাড়ি, আদাবরে পিসিকালচার হাউজিংয়ে ছয়টি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা উচ্চ আদালতকে জানিয়েছে দুদক।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এসব সম্পদের মূল্য কোথাও উল্লেখ নেই এবং প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। তবে নিরপেক্ষ প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। এসব সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করা গেলে অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের মূল্য আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সম্পদের তথ্য ছাড়াও অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে আরো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। গত ৩০ জুন অনুসন্ধান প্রতিবেদন দুদকে দাখিল করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে অগ্রগতি প্রতিবেদনে।

সূত্র : কালের কণ্ঠ 

শেয়ার করুন:

Recommended For You