৭ কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় ব্যাংক কর্মকর্তা ফয়েজ

৭ কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় ব্যাংক কর্মকর্ত ফয়েজ

৫দিনের ছুটি নিয়ে ১৭দিনেও ফেরেননি রায়পুর জনতা ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার ফয়েজ আহম্মেদ। শেয়ার ব্যবসার কথা বলে শতাধিক মানুষের প্রায় সাত কোটি টাকা নিয়ে স্ত্রীর অসুস্থতার চিকিৎসা জনিত ছুটি নিয়ে কানাডায় চলে গেছেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার জনতা ব্যাংকের শাখার সেকেন্ড অফিসার ফয়েজ আহাম্মদ (৩৫)। ব্যাংকের ভিতরেই নিজস্ব ব্যাংক বলয় গড়ে তোলেন ফয়েজ সবার আড়ালে।

এ ঘটনায় জসিম উদ্দিন নামের থাই গ্লাস মালিক ০৯ জুলাই বিকালে তার এক কোটি ২২ লাখ টাকা উদ্ধারের জন্য লক্ষ্মীপুর আদালতে মামলার আবেদন করেছেন। তবে এখনও মামলার শুনানি হয়নি। পাশাপাশি প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা টাকার জন্য প্রতিদিন ব্যাংক ও ফয়েজের বাড়িতে ধরনা দিচ্ছেন। ফয়েজ আহাম্মদ উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের মৃত জয়নাল জমাদ্দারের ছেলে। গত আট বছর জনতা ব্যাংকের রায়পুর শাখায় সেকেন্ড অফিসার হিসেবে লোন দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন।

জনতা ব্যাংকের রায়পুর শাখা সূত্রে জানা যায়, ফয়েজ আহাম্মদ অনেকের নামে ঋণ জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আত্মাসৎ করেছেন। আবার অনেকের ঋণের টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। পাশাপাশি ওই ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই ঋণ পরিশোধ না করায় তার বাড়ির সামনে নিজের মালিকানাধীন মার্কেটে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ফয়েজকে উপজেলার ৬০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের লোন দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাগজপত্র জালিয়াতি করে অনেক শিক্ষকের নামে দুই থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ তুলেছেন। একইভাবে নিজ এলাকার মানুষ, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের লোনের লাখ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। গত মে মাসে কর্মস্থল থেকে লাপাত্তা হলে বিষয়টি জানাজানি হয়।

রায়পুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের থাই ওয়ার্কশপের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ফয়েজ আমাদের গ্রামের ভদ্র ছেলে বলে সবাই জানতেন। ব্যাংকে শেয়ার ব্যবসা করে অধিক মুনাফা দেবে বলে আমার কাছ থেকে এক কোটি ২২ লাখ টাকা নিয়েছিল। কয়েক মাস মুনাফা দিয়েছিল। সম্প্রতি আমার এক বন্ধু এসে জানায়, ফয়েজ তোমারসহ অনেকের সাত কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় চলে গেছে। শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। পরে ব্যাংকে ও তার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বিদেশে চলে গেছে। নিরুপায় হয়ে টাকা উদ্ধারের জন্য আদালতে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলার আবেদন করেছি। আমি টাকা ফেরত চাই।’

ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন

একই অভিযোগ করেছেন ওই ইউনিয়নের নতুনবাজার এলাকার ছাগল ব্যবসায়ী জাকির হোসেন। তিনি জানান, শেয়ার ব্যবসার কথা বলে তার কাছ থেকে ৭৩ লাখ টাকা নিয়েছেন ফয়েজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একইভাবে শেয়ার ব্যবসার কথা বলে প্রতারণা করে অন্তত ৫০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ করে তিন কোটি টাকার বেশি নিয়েছেন। অন্তত ২০ জন শিক্ষক ও ব্যবসায়ীর নামে জালিয়াতি করে ঋণ তুলেছেন। ২০ গ্রাহকের ঋণের টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

দেবীপুর গ্রামের সায়েস্তানগর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক ও ওষুধ দোকানি রেজওয়ান বলেন, ‘গত সপ্তাহের ১ম দিকে জনতা ব্যাংকের এক অফিসার ফোন দিয়ে বলেন, ১০ লাখ টাকা লোনের কিস্তি পরিশোধ করছেন না কেন? এতে আমি হতবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি কীসের ১০ লাখ টাকা, কীসের কিস্তি? আমি তো কোনও লোন নিইনি। তখন অফিসার ফোন কেটে দেন। পরে ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, আমার নামে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন ফয়েজ। অথচ আমি বিষয়টি জানি না।’

শুধু রেজোয়ান নন, শায়েস্তানগর গ্রামের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন, মো. ইব্রাহীম ও আলাউদ্দিনসহ ২০ জনের বেশি ব্যবসায়ীকে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে পাঁচ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন। নাসির উদ্দিন ও মো. ইব্রাহীম জানিয়েছেন, ফয়েজ অনলাইনে জমজমাট ডলার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

এসব মানুষের টাকা নিয়ে কানাডায় চলে যাওয়ার কথা স্বীকার করে গত সোমবার রাতে নিজের ফেসবুক থেকে লাইভ করেছেন ফয়েজ আহাম্মদ। তবে কতজনের কত টাকা নিয়েছেন, তা স্বীকার করেননি। ফেসবুক লাইভে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যাংকে চাকরির পাশাপাশি বেশি লাভের আশায় ব্যাংক, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার ব্যবসা শুরু করেছিলাম। গত কয়েক মাস ব্যবসার মুনাফা দিয়ে সম্প্রতি জার্মানিতে চলে গেছে আমার সেই বন্ধু। সে যে জার্মানির নাগরিক, তা আমি জানতাম না। এখন সে আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করছে না। ফলে মানুষের কাছ থেকে নেওয়া টাকা নিয়ে বিপাকে পড়েছি। এ অবস্থায় গোপনে এক বন্ধুর মাধ্যমে স্ত্রীর চিকিৎসার কথা বলে ছেলেকে নিয়ে ভারত হয়ে কানাডায় চলে এসেছি। আমি জানি, কাজটি অন্যায় হয়েছে। কিন্তু এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। এজন্য সবার কাছে ক্ষমা চাইছি। ব্যাংক ও সবার ঋণের টাকা ধীরে ধীরে পরিশোধ করবো।’

দেবীপুর গ্রামে ফয়েজের বাড়িতে গিয়ে তার নানা নজরুল জমাদ্দারকে পাওয়া যায়। নাতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্ত্রীর চিকিৎসার কথা বলে ঢাকায় গিয়েছিল। পরে ভারত নাকি কানাডায় গেছে, তা আমি জানি না। আমাকে বলে যায়নি। কোরবানির ঈদের আগে কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। এলাকার অন্তত ১৫-২০ জন মানুষ আমার কাছে এসে টাকা চেয়েছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়ির সামনে মার্কেট করেছে। সেই লোনের টাকা না দেওয়ায় গত বৃহস্পতিবার মার্কেটের সামনে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সে কেন মানুষের সঙ্গে এমন কাজ করলো, আমি বুঝতেছি না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের রায়পুর শাখার ব্যবস্থাপক তারেক মোহাম্মদ মুছা বলেন, ‘সেকেন্ড অফিসার ফয়েজ আহাম্মদ তার স্ত্রীকে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করাবেন বলে গত ২৬ মে পাঁচ দিনের ছুটি নেন। এরপর থেকে আর ব্যাংকে আসেননি। তার কাছে ঋণের পাঁচ লাখ টাকা পাবে ব্যাংক। এজন্য নোটিশ পাঠানো হয়। জবাব না আসায় তার বাড়ির সামনে মালিকানাধীন পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট মার্কেটের সামনে নোটিশ টানানো হয়েছে। ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজার শারমিন ভাটের সময়ে এই কাজ করেন ফয়েজ। আমি দুই মাস হলো যোগদান করেছি। তবে গ্রাহকদের কত টাকা নিয়েছেন, তা আমার জানা নেই।’

গত মাসে জনতা ব্যাংকের লক্ষ্মীপুর সদর শাখায় বদলি হয়েছেন সাবেক ম্যানেজার শারমিন ভাট। গ্রাহকদের কত টাকা নিয়েছেন ফয়েজ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনও গ্রাহকের টাকা নেননি ফয়েজ। তবে কারও নামে ঋণ জালিয়াতি করেছেন কিনা, তা আমার জানা নেই।’ রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন ফারুক মজুমদার বলেন, ‘জনতা ব্যাংকের লোন অফিসার ফয়েজ আহাম্মদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শেয়ার করুন:

Recommended For You