কোন জাতিকে ধ্বংস করতে আপনার বোমার প্রয়োজন নেই দুর্নীতি ও অনিয়মই সেটার জন্য যথেষ্ট। দুর্নীতি এমন একটা বৃক্ষ, যার শাখাগুলি অসম্ভব রকমের দীর্ঘ আর তারা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এটি হলো একটি ক্যান্সার, যা গণতন্ত্রের প্রতি নাগরিকের বিশ্বাসকে নষ্ট করে আর উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার প্রবৃত্তিকে হ্রাস করে। আর দুর্নীতি ও অনিয়মই যখন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় তখন শিক্ষার আলো সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য হয় মরীচিকা।
বলতেছিলাম রাজধানী পুরান ঢাকার ৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের কথা। একসময় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ছিল বহু শিক্ষার্থীর স্বপ্নদুয়ার যা এখন অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির কারণে নীরবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠেছে আসছে এই ক্যাম্পাসের দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ। তবে তারপরও থেমে নেই এই ক্যাম্পাসের কলেজ প্রশাসনের দুর্নীতি আর অনিয়ম।
ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে শিক্ষার্থীদের যাতায়ের জন্য নেই কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা। অথচ, প্রতিবছর সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া হচ্ছে পরিবহন খরচ। সেই টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে ? সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নেই কোনো সদুত্তর। এছাড়াও, নানা অনিয়মে কলেজের ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হলেও কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য রীতিমতো বিস্ময়কর।
চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক শিক্ষার্থীদের যাতায়ের জন্য কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা না থাকলেও ,পরিবহনের খাত দেখিয়ে প্রতি বছর যেভাবে কলেজ প্রশাসন হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা-
২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে প্রতি বছর ভর্তি হয় প্রায় ১৯৯৫ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদে ৭৪০ জন, বাণিজ্য অনুষদে ৪০০ জন এবং কলা ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে ৮৫৫ জন। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের ৪র্থ বর্ষের ভর্তি ফি বিবরণীতে উল্লেখ রয়েছে, পরিবহন বাবদ ১০০ টাকা। সেই হিসেবে প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটি এক সেশনে পরিবহন বাবদ পায় ১,৯৯,৫০০ টাকা। অর্থাৎ স্নাতকের ৪টি বর্ষ থেকে প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি পরিবহন খাত থেকে নিচ্ছে ৭,৯৮,০০০ টাকা। এ তো গেলো স্নাতক, বাকি থাকল স্নাতকোত্তর। প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে ১৭টি বিভাগে স্নাতকোত্তরের সুযোগ। সেই হিসাবে পরিবহন খাত থেকে আরো আসে প্রায় ২ লক্ষ টাকা। তাহলে পরিবহন খাতে সোহরাওয়ার্দী কলেজের আয় বছরে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা।
এছাড়াও সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয় প্রায় দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। সেই হিসাবে সেখান থেকেও আয় প্রায় ২ লাখ টাকা। তাহলে সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, এক পরিবহন খাত দেখিয়েই প্রতিবছর কলেজ প্রশাসনের আয় হচ্ছে ১২ লাখের বেশি টাকা। এই টাকা আসলে ব্যয় হচ্ছে কোথায়? কে এই টাকা ব্যয় করছে তার কোন সদুত্তর মেলেনি কলেজ প্রশাসনের কাছ থেকে। এই বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য না পেয়ে যোগাযোগ করা হয় তাদের অফিসে। কিন্তু সেখানেও মেলে নি কোনো তথ্য।যেহেতু পরিবহন নেই- তাই এই বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য বা কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।
কলেজটির শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম বলেন, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে দশ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু তারপরেও প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। পরিবহন ব্যবস্থা না থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বছর মাথাপিছু ভর্তি ফির সাথে ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এবিষয়ে জানার চেষ্টা করলেও কলেজ কতৃপক্ষ জানায়নি পরিবহন খাতের টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে। পরিবহনের টাকা কোথায় খরচ হয় জানতে চেয়ে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন করেন । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, শুধু পরিবহন না কলেজ কতৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিচ্ছে শিক্ষা সফরের টাকা। কিন্তু শিক্ষা সফর হয় না। ওই শিক্ষার্থী আরো বলেন, কেন নেওয়া হচ্ছে এই টাকা? কোন খাতে এই টাকা খরচ করা হচ্ছে?
এ বিষয়ে জানার জন্য কথা হয় কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে। তিনি বলেন, আমি শুধুমাত্র একাডেমিক বিষয়গুলো দেখি, আর্থিক বিষয়গুলো দেখি না। ক্লাস সঠিক সময়ে হচ্ছে কি না, ইনকোর্স পরীক্ষা হচ্ছে কিনা এটা দেখি।
বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হয় কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোহসিন কবীরের সাথে। তিনি বলেন, আমাদের একটি গাড়ি আছে, যেটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে ক্রয় করা হয়েছে। পরিবহনের খাতে উত্তোলিত টাকা দিয়ে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। পরিবহন খাতের টাকা নেওয়া হচ্ছে নিয়ম মেনে। এখানে কোনো সমস্যা নেই। তবে জানা যায়, ওই প্রাইভেট গাড়িটি কলেজ অধ্যক্ষ অফিসে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেন। অধ্যক্ষ যে গাড়িটি ব্যাবহার করেন- সেবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার হয় না। কলেজের বিভিন্ন কাজে, যখন পরীক্ষা-টরীক্ষা থাকে তখন ব্যবহৃত হয়।
প্রতি বছর প্রায় আট নয় হাজার স্টুডেন্ট এখানে ভর্তি হয়। পরিবহন খরচবাবদ জনপ্রতি ১০০ টাকা তো অনেক টাকা। এর এক টাকাও কি শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে খরচ হয়? তাহলে পরিবহনের জন্য প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা কেন নিচ্ছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তো আজকে থেকে না, অনেক আগে থেকেই- যখন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে গাড়ি কেনা হয়েছে তখন থেকেই এমন হচ্ছে। আমি তো কয় বছর হয় এসেছি, কিন্তু এটা তো আগে থেকেই হচ্ছে। বাংলা কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, সব কলেজেই এমনভাবে হয়। প্রশাসনিকভাবে কোনো সমস্যা নেই এবং ফান্ডের টাকাটি পরবর্তী খরচের জন্য রেখে দেওয়া হচ্ছে বলেই জানান তিনি। তবে, পরিবহন খাত ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে বিভিন্ন খাত নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কলেজটিতে প্রাক-নির্বাচনি ও নির্বাচনি পরীক্ষা বাবদ টাকা নেওয়া হলেও শুধু নির্বাচনি পরীক্ষাই অনুষ্ঠিত হয়। এই বিষয় নিয়ে বিবার্তার পক্ষ থেকে জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোহসিন কবীর এরকম কিছু জানেন না বলে জানান।
কলেজের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষা সফরের কথা বলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া হয়, সেই টাকার অঙ্ক শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় হওয়া মূল খরচকেও ছাড়িয়ে যায়। আরো জানা যায়, সফরে যাওয়া শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের চাঁদার টাকাতেই শিক্ষা সফরে যান। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আড়ালে কথা বললেও, সম্মুখে বলতে চায় না। তবে অধ্যক্ষের দাবি, কলেজ থেকে শিক্ষা সফরের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়। যেসব বিভাগে শিক্ষা সফরে যাওয়া বাধ্যতামূলক, সেসব বিভাগে ভর্তুকি দেওয়া হয় এবং শিক্ষার্থীদের থেকে অল্পকিছু খরচ নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শিক্ষা সফরের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে আরো জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন বিভাগে এমন হচ্ছে জানান। বাংলা ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে এমন হচ্ছে জানালে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান অধ্যক্ষ। তবে, অধ্যক্ষ সকল অনিয়মের বিষয়েই ‘খতিয়ে দেখা’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডে দীর্ঘ সময় ধরে কলেজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য,পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার রোডের শেষ মাথায় হাতের বাম পাশে মেইন রোড থেকে কিছুটা ভিতরে মাত্র ১ একর জায়গায় উপর অবস্থিত ৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ। ১৯৪৯ সালে নালগলার ৫/১, জুম্মন ব্যাপারী লেনে ( ভাওয়ালরাজ এসেস্ট) কলেজটির কার্যক্রম শুরু হয়।তখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপাধি অনুসারে কলেজের নাম রাখা হয় কায়েদ- ই- আজম কলেজ। পরবর্তীতে লক্ষ্মীবাজরে জমি ক্রয় করে কলেজটিকে সেখানে স্থানান্তর করা হয় এবং নালগলার ভবনটিকে ছাত্রাবাসে রূপান্তর করা হয়। ১৯৫০ সালে সৈয়দ জহির আহসান কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুরুতে কলেজটিতে কেবল আই.এ, আই.কম এবং বি.কম. কোর্স চালু ছিল। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে কলেজটিতে বি.এস.সি কোর্স চালু হয়। এটিই ঢাকার মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য উচ্চশিক্ষার প্রথম কলেজ। কারণ সে সময় ঢাকার অন্য কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল নাহ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে কলেজটির নাম পরিবর্তন করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামানুসারে কলেজটির নাম রাখা হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। পরে ১৯৮৪ সালে ১ নভেম্বর কলেজটি সরকারি কলেজে পরিণত হলে এর নাম রাখা হয় সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। কলেজটির সংক্ষিপ্ত নাম জি এস এস সি। ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষে কলেজটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু করে।
সর্বশেষ, ২০১৭ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলে, সেখানে স্থান পায় সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ।
ডব্লিউ জি /এমএলএইচ