আগামী আগস্ট মাস হতে জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর ও কালুনগর খালের চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্তি কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ঢাদসিক) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
শনিবার (৬ জুলাই) সকাল ১১.০০টায় ঢাকা ইউটিলিটি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডুরা) এর উদ্যোগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টিতে খাল পুনরুদ্ধারের ভূমিকা’ শীর্ষক ‘ডুরা সংলাপ’ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এসব তথ্য জানান।
ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, “আমরা যে খালগুলো ওয়াসার কাছ থেকে পেয়েছি তার মধ্যে জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর এবং কালুনগর খাল চারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই চারটি খাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকে আমাদের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। একইসাথে আপনারা জানেন, খালগুলোর পাওয়ার পর হতেই ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি হতে আমরা প্রাথমিকভাবে দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করি। আমরা লক্ষ্য করি, শ্যামপুর খালের একটি অংশ ১০০ ফুট প্রশস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে আমরা পেয়েছি ৮ ফুটের একটি নালা। এরকম চিত্র কিন্তু প্রায় সব জায়গায়। এখন আমরা এই প্রকল্পের আওতায় সিএস, আরএস, এসএ নকশা, বিষদ অঞ্চল পরিকল্পনা এবং পানি আইন অনুযায়ী এই ৪ খালের চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্তি কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। আগামী মাস থেকে ব্যাপকভাবে আমরা এই কার্যক্রম শুরু করব। এখানে আমরা কঠোরভাবে দখলমুক্ত করব। এ কাজে অনেক প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অনেক চাপ, প্রভাব রয়েছে। সেই চাপ, প্রভাব, প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় আমি গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, নগর পরিকল্পনাবিদ, ঢাকাবাসীর সোচ্চার ভূমিকা ও সহযোগিতা কামনা করছি। আপনাদের সকলের সহযোগিতায় আমরা চূড়ান্তভাবে খালের সীমানা নির্ধারণের পাশাপাশি সকল অবৈধ দখলদারদের কবল হতে খালগুলো মুক্ত করব ইনশাআল্লাহ।”
জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত ৪ বছরে গৃহিত ও বাস্তবায়িত নানা উদ্যোগ তুলে ধরে ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, “মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার পর যেসব জায়গায় আধাঘন্টার বেশি বৃষ্টির পানি জমা থাকে সেসব জায়গা ও স্থানকে জলাবদ্ধ বলে আমরা চিহ্নিত করছি। ২০২০ সালের পর হতে আমরা এ রকম ১৬১টি জায়গা-স্থান চিহ্নিত করেছি এবং ইতোমধ্যে ১৩৬টি জায়গা ও স্থানে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নে করে জলাবদ্ধতা নিরসন করতে সক্ষম হয়েছি। বাকী জায়গাগুলোতে কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও, এবার ঘুর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ও গতবছর নতুন কিছু জায়গা প্লাবিত হয়েছে। এরকম আরো ৫০টি জায়গা আমরা চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে নিউমার্কেট এলাকা, নায়েম সড়ক, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে গতবছর নতুন করে জলাবদ্ধতা পেয়েছি। সেটি যখন আমরা তদন্ত করে কারণ উদঘাটন করলাম, তখন আমরা দেখলাম — একে তো নর্দমাগুলো পুঞ্জিভূত ময়লা জমে-জমে ভরে গেছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, ওই এলাকার পানি নিষ্কাশনের অবকাঠামো ও নর্দমা অন্তর্জাল ছিল পিলখানার ভেতর দিয়ে। ২০০৯ সালের ঘটনার পরে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেসব নর্দমার মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা দীর্ঘদিন তাদের (বিজিবি) সাথে দেনদরবার করেছি। আমরা বিজিবি’র অনাপত্তি পেয়েছি। এখন আমরা পিলখানার ভেতর দিয়ে বড় নর্দমা করার এবং বিকল্প হিসেবে আজিমপুর কবরস্থানে পাশ দিয়ে নর্দমা তৈরি করে তা বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। সেটির দরপত্র প্রায় শেষ। ইনশাআল্লাহ অল্প কিছু দিনের মধ্যে এ কাজ শুরু করতে পারব।”
বিগত দিনে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার নানা অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরে এবং সেসব অসঙ্গতি মোকাবিলার মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহিত কার্যক্রম নিয়ে ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, “পুরাতন ঢাকার মূল জায়গা বংশাল, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া। বংশালে দীর্ঘ ৪০ বছর কোন কাজ হয়নি। আপনারা জেনে অবাক হবেন, অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি, নিকটবর্তী স্থান দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করে প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার ঘুরিয়ে দূরবর্তী স্থান দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই বংশাল এলাকার পানি ফুলবাড়িয়া হয়ে নর্থ-সাউথ সড়ক দিয়ে ধোলাইখাল হয়ে বুড়িগঙ্গায় নিষ্কাশিত হতো। আমরা সেটি ৬ ফুট ব্যাসের নর্দমার মাধ্যমে সরাসরি বাবুবাজার সড়ক দিয়ে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, আগামী ৩০ বছরেও সেখানে আর জলাবদ্ধতা হবে না। একইভাবে শিক্ষা বোর্ডের সামনে গতবছর আমরা জলাবদ্ধতা পেয়েছি। সেখানেও দেখলাম, শিক্ষা বোর্ড বকশিবাজার হতে আজিমপুর হয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা সেটা সরাসরি বকশিবাজার হতে চকবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গায় নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। কারণ, স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী নিকটবর্তী স্থান দিয়েই পানি নিষ্কাশন হবে। কিন্তু দূরবর্তী স্থান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে তা ধীর হয়ে যায়। আর যত ধীর হবে তত বেশি জলাবদ্ধতা হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে এরকম অনেক অসঙ্গতি আমাদেরকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে এবং ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা মুক্ত নগরী উপহার দিতে আমরা সেটা করে চলেছি।
আরও পড়ুন: সুষ্ঠুভাবে আরও বেশি সেবা দিতেই তথ্যকেন্দ্র: ঢাদসিক মেয়র
ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস সময়োপযোগী এই আয়োজনের জন্য ডুরা-কে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, “আমি জানি মেয়র মহোদয় খুবই শক্ত অবস্থান নেন। কিন্তু যারা যারা খাল দখল করেছেন- তারাও কিন্তু কম শক্তিশালী না। দখলদারদের নামগুলো দেখলেই বুঝবেন তারাও কতটা শক্তিশালী। সুতরাং এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে যে, আমরা উদ্ধার কাজটাও করবো, একই সঙ্গে স্থায়ী সংরক্ষণের একটা ব্যবস্থা গ্রহন করব। এজন্য সরকারের কমিটমেন্ট দরকার।”
সমন্বয়হীনতার কারণে খাল উদ্ধার অসম্ভব মনে করে শ্যামল দত্ত বলেন, “রামচন্দ্রপুর খাল নিয়ে খালি গল্পই শুনছি। সেখানে রামের বাহিরে রামের একটা বোন সীতাও আছে। তার একটা বাড়িও আছে সেখানে। তিনি আবার গানও করেন। সেই সীতা নাকি আলাদাভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে খালের জায়গায় ভবন নির্মাণের অনুমতিও নিয়েছেন। ফলে সাদিক এগ্রো উচ্ছেদ হওয়া নিয়ে খুশি হয়ে কোনো লাভ নেই, যদি খালটা কাজে না আসে।”
বিদ্যমান সাংঘর্ষিক কিছু বিষয় উপস্থাপন করে ভোরের কাগজ সম্পাদক বলেন, “একটা শহরে সরকারের ১৪টার মতো সেবা সংস্থা কাজ করে। সিটি করপোরেশন শুধু একাই সরকারের একটা সংস্থা নয়। ওয়াসা বলে তারা স্বাধীন, রাজউক বলে তারাও স্বাধীন। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো- রাজউক স্বাধীন সংস্থা হলেও সিটি করপোরেশনের নগরায়ণের পরিকল্পনা দেয় রাজউক। অথচ দুই সংস্থার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এটি সাংঘর্ষিক নীতি বলে মনে করেন তিনি।”
আরও পড়ুন: নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই: ঢাদসিক মেয়র
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ সময় মেয়রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “খাল উদ্ধার করে কি করবেন? রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তো খালের পাড়ে ১৪ তলা ভবনের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এখানে সিটি করপোরেশন কি করবে? সিটি করপোরেশন কি ভাঙতে পারবে?”
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করে হাতিরঝিলে ২০০ কোটি টাকার বিজিইএমইএ ভবন ভাঙিয়েছে। কিন্তু সেখানে এখন যা হচ্ছে তা বন্ধে কোনো পরিবেশবাদীদেরকে দেখি না। উল্টো শুনছি- সেই প্রকল্পে তারা পরিকল্পনাবিদ হিসেবে কাজ করছেন। তাহলে খাল উদ্ধার করে লাভ কি?”
খাল বেদখলের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড.আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “ঢাকা শহরের খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর হয়েছে। নগর পরিকল্পনার দৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমরা সবাই জানি, ঢাকা শহরের খালগুলোর মালিকানা নগরীর বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত আছে। প্রধানত জেলা প্রশাসনের কাছে সব খালের মালিকানা থাকলেও অন্যান্য সংস্থা যেমন ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশনগুলো, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রভৃতি সংস্থা ঢাকা শহরের খালগুলোর তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন নিয়োজিত থাকলেও খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকিতে নগর সংস্থাগুলোর মধ্যে আন্তঃসমন্বয় ছিল না এবং খালগুলোর প্রকৃত অভিভাবক কেউ ছিল না। ঢাকা মহানগরের বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে খালগুলোকে কেন্দ্র করে যে নগর পরিকল্পনার সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিয়ে অব্যাহত দখল আর দূষণের মাধ্যমে খাল ও জলাশয়গুলোকে আমরা উন্নয়নের নামে ক্রমাগত ধ্বংস করেছি। ফলে একদিকে যেমন নগরীর পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস হয়েছে, ঠিক তেমনি নগরায়ণের চাপে শহরের খালগুলো ক্রমান্বয়ে দখলের শিকার হয়েছে। একই সঙ্গে খালগুলোর দৈর্ঘ্য কমে যাওয়ার কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার নেটওয়ার্ক হিসেবে নগরের খালগুলো তাদের কার্যকারিতা হারিয়েছে বহুলাংশে।”
তিনি আরো বলেন, “সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতা থাকলে খালগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। পাশাপাশি খালগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনামাফিক প্রকল্প হাতে নিলে খালগুলোর অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং খালের মধ্যে বৃষ্টির পানির ধারণক্ষমতা এবং পানিপ্রবাহের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হবে।”
ডুরার সভাপতি ওবায়দুর মাসুমের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মোল্লার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে দক্ষিণ সিটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ, সংরক্ষিত আসনের নারগীস মাহতাব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।