বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্রষ্টা রাজনৈতিক সংগঠনটির নাম নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ। জাতি হিসেবে আমাদের যা কিছু ইতিবাচক অর্জন আর অগ্রগতি সব এ দলটির হাত ধরেই। মহান এ দলটির হীরক জয়ন্তী বা ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে আজ ২৩ জুন।
স্মর্তব্য, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পুরোনো ঢাকার টিকাটুলীর কে. এম. দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালে দলটির সভাপতি ছিলেন জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। পরে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীরই উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নতুন নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর দলটির নাম স্বভাবতই পাল্টে গিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হয়ে যায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এরপর চার বার তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া দলের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সম্মেলনে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের জন্মের সঙ্গে ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলির পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের সম্পর্ক অনস্বীকার্য। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কর্মী শিবিরের নেতা শওকত আলী। তাঁর উদ্যোগে ১৫০, মোগলটুলিতে শওকত আলীর বাসভবন এবং কর্মী শিবির অফিসকে ঘিরে বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর ২৩ জুনের কর্মী সম্মেলনে নতুন দলটির নাম ঘোষণা করা হয়।
ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন
শওকত আলীর অনুরোধে কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার কাজে ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে আলাদা একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। শওকত আলী এ পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। শামসুল হক এসময় কর্মী শিবিরের প্রধান নেতা ছিলেন। কামরুদ্দীন আহমদ, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা প্রমুখ প্রথম দিকে এবং পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান কর্মী শিবিরকেিিন্দ্রক রাজনৈতিক তৎপরতায় বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। মুসলিম লীগের আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের নেতারা মুসলিম লীগের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই এখানে কর্মী শিবির গড়ে তুলেছিলেন।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকা এলে তার সঙ্গে শওকত আলীর আলোচনা হয়। শওকত আলী মওলানাকে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জানান। এ বিষয়ে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে শওকত আলীর প্রাথমিক আলোচনা হয়। এ আলোচনার সূত্র ধরে নতুন দল গঠনের জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন শওকত আলী। এজন্যে ১৫০, মোগলটুলিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মওলানা ভাসানী সে বৈঠকে যোগ দেন। এসময় খোন্দকার আবদুল হামিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শওকত আলীর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক এবং খন্দকার মুশতাক আহমদকে দপ্তর সম্পাদক করে একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।
এই সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৯-এর ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক সম্মেলনের ডাক দেয়। রোজ গার্ডেনে ২৩ জুন বিকেল ৩টায় এ সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উপস্থিত নেতাদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ, ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ।
প্রতিষ্ঠাকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ. কে. রফিকুল হোসেন (খায়ের মিয়া)- কে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ মনোনীত হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। প্রসঙ্গত, শেখ মুজিব তখন কারাবন্দী ছিলেন। পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
২৪ জুন বিকেলে নবগঠিত আওয়ামী মুসদিলম লীগ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্যে জনসভা করে। এ সভায় প্রায় চার হাজার লোক যোগ দেয়। ১৯৫২-তে বঙ্গবন্ধু সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাঁকে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ পর্যন্ত টানা তেরো বছর দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিলো তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। দলটির প্রধান দাবিদাওয়ার মধ্যে ছিল বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, এক ব্যক্তির এক ভোট ব্যবস্থা চালু করা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য দূর করা।
১৯৫৪’র নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ লক্ষ্যে ১৯৫৩’র ৪ ডিসেম্বর দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলামের সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৩টি যুক্তফ্রন্টের দখলে যায়। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ একাই জয়ী হয় ১৪৩টি আসনে। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। ১৯৫৫-তে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনে সকল ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী একটি উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দলটিকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। সে-বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন। মূলত এ আন্দোলনের মধ্যেই পরবর্তী কালের স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ প্রোথিত ছিল। ১৯৬৬’র ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফা দাবির মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে একটি যৌথরাষ্ট্রে পরিণত করা এবং ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা। ছয় দফার সমর্থনে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লালদিঘি ময়দানে চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও এক দফার প্রবক্তা চট্টল শার্দুল জননেতা এম. এ. আজিজের নেতৃত্বে প্রথম প্রকাশ্যে সভা করেন বঙ্গবন্ধু। সে-সভায় আজিজ ঘোষণা করেন, ছয় দফা না মানলে এক দফার আন্দোলন চলবে, এবং সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার আন্দোলন। পরবর্তীতে এই ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা জেনারেল আইয়ুব খান সরকারের। এ সময় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ এবং আরো কিছু ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে তাদের ঐতিহাসিক এগারো দফা কর্মসূচি পেশ করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
স্বৈরাচারী আয়ুবশাহীর পতনের পর ১৯৭০-এ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় ক্ষেত্রে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ নির্বাচন এক উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে রয়েছে। এতে পাকিস্তানের ৩১৩ আসনের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠন ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পায় দলটি। জাতীয় পরিষদের সাতটি মহিলা আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের দশটি মহিলা আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানোর বদলে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার পথ বেছে নেয় পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ঢাকার রেস কোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে) অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে প্রদত্ত এক যুগান্তকারী ভাষণে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেন। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাক স্বৈর সরকার ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তার আগে তিনি লিখিতভাবে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দিয়ে যান, যা চট্টগ্রামের কালুরঘাটের অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের নিয়ে ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিতি লাভ করে। পাকিস্তানে কারাবন্দী আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতেই তাঁকে এ সরকারে রাষ্ট্রপতি পদ প্রদান করা হয়। ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে এ সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়। অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জনের মধ্যে দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে নবজাত বাংলাদেশের। ১৯৭২-এর শুরুতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে দল ও সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে চার চার বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট দলের কিছু বিশ^াসঘাতক আর সামরিক বাহিনীর কিছু পাকিস্তানপন্থী সদস্য মিলে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতাদেরকেও বন্দী করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নভেম্বরের ৭ তারিখে কারাগারের ভেতরেই দলের চার শীর্ষ নেতা তথা বঙ্গবন্ধু সরকারের সদস্যকেও হত্যা করা হয়। এর ফলে পরবর্তী প্রায় দু দশকের জন্যে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে গভীরতম অন্ধকার নেমে আসে। দেশ পুনরায় সাম্প্রদায়িক পাকপন্থীদের দখলে চলে যায়।
কিন্তু বিদেশে থাকার সূত্রে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করে পুনরায় দলটিকে তার চিরাচরিত আন্দোলন-সংগ্রামের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। শেষপর্যন্ত ১৯৯৫-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রায় কুড়ি বছর পর আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। এর পর ২০০০ সালের নির্বাচনে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দলটির নির্বাচনী বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হলেও, ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে উপর্যুপরি জয়ের মাধ্যমে রেকর্ড সৃষ্টি করে বাঙালি জাতির প্রাণের দল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ এক আজন্ম সংগ্রামী দলের নাম, তবে সরকারি দল হিসেবেও এর অর্জন অপরিসীম। পর পর তিনটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে গত প্রায় দেড় দশক ধরে টানা ক্ষমতাসীন দলটি তথা এর সূর্যপ্রতিম নেত্রী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শনৈ শনৈ এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে। ইতোমধ্যে দেশটি পরিণত হয়েছে উন্নয়নশীল থেকে স্বল্পোন্নত দেশে এবং দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে উন্নত দেশ অভিধা অর্জনের দিকে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের শাসনাধীন বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের রোল মডেলে।
আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীজড়িত ও অবিচ্ছেদ্য। আজকের বাংলাদেশ বস্তুত আওয়ামী লীগেরই অবদান। মহান এ দলটি হীরক জয়ন্তী উদযাপন করছে, এদেশের অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি জাতীয়তাবাদী, মুক্তিযুদ্ধর চেতনাবাহী জনগণের জন্যে এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর হতে পারে না। দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, টানা চতুর্থ মেয়াদ এবং মোট পঞ্চম মেয়াদে সরকার গঠন করার পর এবার ক্ষমতাসীন অবস্থায় থেকে ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর আগে পঁচিশ বছরে রজত জয়ন্তী ও পঞ্চাশ বছরে সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের সময় দলটি ক্ষমতায় ছিল না। এবার ক্ষমতাসীন অবস্থাতেই পঁচাত্তর বছরের হীরক জয়ন্তী পালন করছে দলটি। স্বভাবতই খুব জাঁকজমকের সঙ্গে দিনটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এ নিয়ে সম্প্রতি গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় কর্মকৌশল ঠিক করতে দলের সম্পাদকমণ্ডলীকে দায়িত্ব দেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শতবর্ষ পূর্ণ করে সগৌরবে প্লাটিনাম জয়ন্তী পালন করুক, এটাই আমাদের একান্ত কামনা। সেদিন হয়তো আমাদের অনেকেই এ পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু আমাদের শুভেচ্ছা আমৃত্যু, এমনকি মৃত্যুর পরও থেকে যাবে মহান এই রাজনৈতিক দলটির সঙ্গেই।
লেখক: ড. মো: শাহিনুর রহমান
অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ ও সাবেক উপ-উপাচার্য,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, ও লেখক ।