রাজশাহীতে দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে পদ্মা, কর্তৃপক্ষ নিরব

অন্তত ৬ শতাধিক দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে রাজশাহীর পদ্মা নদী। পদ্মার তীরবর্তী এলাকা এবং নদীর পানি শূন্য অংশও নদী ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে নিচ্ছেন না কোন পদক্ষেপ। যার ফলে প্রতিনিয়িত নদী দখলকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

রাজশাহীতে পদ্মা নদী দখলের যেন মহোৎসবে এমনকি নদীর গতিপথও পরিবর্তন হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নগরীর বেড়পাড়া থেকে তালাইমারী পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার জুড়ে এ দখল বাণিজ্য চলছে। যে যার মতো করে দখল করে রেস্টুরেন্ট, বাড়ি, খেলনার দোকানসহ নানা ধরনের দোকানপাট ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। নগরীর আলুপট্টি এলাকায় পদ্মা নদীর উত্তর পারের তীরের নিচে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বেশকছিু দোকানপাট। স্থানীয় বাসিন্দা ও হিন্দু-বদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত নিজেও একটি অংশ ভরাট করে রেখেছেন। পাশেই ভরাটকৃত স্থানে আরও কয়েকজন ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন ফাস্টফুডের দোকানপাট।

নগরীর পঞ্চবটি এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধের নিচে গড়ে উঠেছে একাধিক বাড়ি। নগরীর বড়কুঠি এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধের নিচে বিশালাকার জায়গা ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ও ফাস্টফুডের দোকানপাট। এসব দোকানপাট অধিকাংশই ভাড়া দেওয়া হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দোকানপাট করে সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন। এখানে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৫০টি দোকান বসে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফাস্টফুড, আঁচার, খেলনার দোকান। এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন দোকানের আয়তন ভেদে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ১০০-২০০ টাকা করে চাঁদা দেওয়া হয়। চাঁদা না দিলে এখানে দোকান করা সম্ভব না।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নগরীর পাঠানপাড়া এলাকায় একটি পার্ক ও রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলে সেটিও ভাড়া দেয়া হয়েছে। লালনশাহ মঞ্চ এলাকায় প্রায় ৫ বিঘা আয়তনের এই জায়গাটি বছর তিনেক আগে ভাড়া দেওয়া হয় জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ খালেদ মাসুদ পাইলটকে। শহর রক্ষা বাঁধের একটি অংশে কাটা তারের বেড়া দিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি পার্ক। তবে এই পার্কটির মনোরম দৃশ্য পদ্মা পাড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। নগরীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হওয়া এই পার্কে শিশুদের জন্য বেশকিছু উন্মুক্ত রাইডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লালন শাহ মুক্ত মঞ্চের পাশে গড়ে তোলা ’নোঙ্গর’ রেস্টুরেন্টেও প্রতিদিন কয়েকশত ভোজনপ্রিয় মানুষ এসে আড্ডা দেন বিভিন্ন খাবার খান। এ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার রিপন আলী বলেন, ‘ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নিকট থেকে লিজ নিয়ে সে ব্যবসা করছি।

অপরদিকে নোঙ্গরের নিচের পদ্মার চরের মধ্যে রাস্তা করে দুই পাশের্^ গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক দোকানপাট। ভাজা, ফুচকা, শিশুদের খেলনার এ সমস্ত দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০-১০০ টাকা চাঁদা তুলেন স্থানীয়রা। চাঁদার বিনিমিয়ে দোকানগুলো বসতে দেওয়া হয়। হাবিল উদ্দিন নামের এক দোকানদার বলেন, দোকান করতে হলে কিছু টাকা তো দিতেই হবে। যারা টাকা নেন. তারা এই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা। টাকা না দিলে কি শৃঙ্খলা থাকবে না, যে যার মতো দোকান করবে।’

পদ্মা নদীতে ঘুরতো আসা এক কলেজছাত্রী বলেন, নদীর মধ্যে দোকান পাট গড়ে উঠার কারণে পদ্মার সৌন্দর্যও অনেকটা বিলিন হয়েছে। পদ্মার জেগে উঠা চরে ঘাস বা লতাপাতা জন্মালেও দেখতে সুন্দর লাগে। কিন্তু চর দখল করে দোকান পাট গড়ে তোলার কারণে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে।’ নগরীর শ্রীরামপুর এলাকাতে নদীর চরের মধ্যে গড়ে উঠেছে শত শত বাড়ি। এসব বাড়িগুলো বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছেন হাজার হাজার মানুষ। শহর রক্ষা বাঁধের নিচেই এ বস্তি এলাকাটি গড়ে তুলেছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘এক সময়ে আমাদের রাজশাহীর পদ্মায় ইলিশ পাওয়া যেত। রাজশাহী শহরের সঙ্গে যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল স্টিমার। কিন্তু নদী এখন মৃতপ্রায়। দখলে দখলে ধুঁকছে পদ্মা। যৌবন হারাচ্ছে পদ্মা। শুধুমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া নদীর প্রায় অধিকাংশ চরে পরিণত হয়। নদী রক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা কোনো সরকারই নেই না। ফলে দখলদাররা আরও বেপরোয়া। আর দখলের কারণে নদী বদালচ্ছে গতিপথ। ভাঙছে দুই পাড়। অনেক মানুষ নিঃশ্ব হচ্ছে। আর আমরা সামান্য স্বার্থেও জন্য নদীকে ধ্বংস করছি।  ‘পদ্মার পাড়, ও ভিতরের চর দখলের কারণে পদ্মা তাঁর স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। পদ্মাকে রক্ষা করতে হবে আমাদের। এমনিতেই প্রতিবেশী দেশ ভারত উজানে ফারাক্কা বাঁধ করে পদ্মাকে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে। সেখানে আমরা যদি আবার নানা প্রতিবন্ধিকতা তৈরী করি, তাহলে পদ্মা আর নদী থাকবে না।’

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, ‘রাজশাহীর বেড়পাড়া থেকে তালাইমারী পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী দখল করা হয়েছে। শতশত একর জমি দখলে ৬০০ দখলদারের তালিকা আমরা করেছি। এদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’

কিন্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, ‘পদ্মা পরে লালনশাহ মুক্ত মঞ্চটি আমরাই গড়ে তুলেছি। সেখানে প্রতিদিন সাংকৃতিক কর্মীরা নানা আয়োজন করেন। ঘুরতে আসা মানুষদের বিনোদন দিচ্ছেন তারা। আবার বিনোদনের অভাবটুকুও পূরণ হচ্ছে।’

সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ‘নদী দখলের বিষয়টি কাজ চলামান রয়েছে। নদী দখল হলে পরিবেশ সমাজের ক্ষতি হবে। দ্রুতই দলকারীদেও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে । যারা অবৈধ দখল করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন:

Recommended For You