কোটা পুনর্বহাল, প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার (৬ জুন) শিক্ষার্থীরা পোস্টার ও প্ল্যাকাট হাতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে।

কোটার বিরুদ্ধে উত্তাল ঢাবি 

বিকেল ৪টায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।

মিছিলে ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক’, ‘স্বাধীনতার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’সহ নানা স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা।

সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ হোসেন বলেন, কোনো বৈষম্যহীন রাষ্ট্রে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকতে পারে না। তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার যেখানে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল, হাইকোর্ট কেন সেই কোটাকে আবার পুনর্বহাল করল; আমরা জানি না। সরকারের সিদ্ধান্তকে হাইকোর্ট বাতিল করেছে। আমরা চাইব সরকারের পক্ষ থেকে যেন আপিল বিভাগে আপিল করা হয়। নয়তো আন্দোলন চলবে।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ২০১৮ সালের রক্তের দাগ আজও শুকায় নাই। আমাদের সেই সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পথে। আমাদের ওপর হাইকোর্ট যে রায় চাপিয়ে দিয়েছেন, সেই রায় মানি না। যারা কোটাধারী মেধাবী পরিচয় দিতে চান তাদেরকে বলতে চাই, এই পরিচয় খুবই লজ্জার।

শিক্ষার্থী সারজিস আলম বলেন, ৭১ এর আগে পাকিস্তান সরকার যে বৈষম্য বাঙালিদের সঙ্গে করেছিল, সেই বৈষম্য আমরা মেনে নিতে পারিনি বলেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে দুই শতাংশ মানুষের জন্য ৫৬ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটাও চরম বৈষম্য। এই বৈষম্য আমরা মানি না। হাইকোর্টের এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেও বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা।

বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধনটি আয়োজন করেন তারা। এ সময় শিক্ষার্থীদের হাতে ‘বৈষম্যমূলক কোটা প্রত্যাহার চাই’; ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি প্লেকার্ড দেখা যায়।

মানববন্ধনে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনিরাও কোটার সুবিধা ভোগ করছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নারীদের কোটার আধিক্য রয়েছে। এ ছাড়া রেলওয়েতেও বিভিন্ন কোটা রয়েছে। তাহলে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনি এবং নারী না হয়ে কি ভুল করেছি? আমরা শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ চেয়েছি। কোটা পদ্ধতি পুনরায় চালু হলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে স্থান পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিজুল ইসলাম বলেন, আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাই, তারা দেশের সূর্য সন্তান। কিন্তু তাই বলে তাদের সন্তান এমনকি নাতি-নাতনিরাও পরিশ্রম কম করে কোটার ভিত্তিতে চাকরিতে যোগদান করবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা কোনো দেশের স্বাভাবিক শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাশরুর আহমেদ বলেন, দেশের বিপুলসংখ্যক বেকার থাকা সত্ত্বেও কোটার মতো বৈষম্যমূলক নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এখন বেকারের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। আর আমরা এখানে কোনো সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে আসেনি, আমরা শুধু আমাদের অধিকার আদায়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। হাইকোর্টের প্রতি সম্মান রেখে আমরা বলতে চাই, হাইকোর্ট যেন মুক্তিযোদ্ধা কোটার পুনর্বহাল রুল বাতিল করেন।

বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা

দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এ আন্দোলন শুরু হয়। পরে মিছিল নিয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক ঘুরে প্রধান ফটকের সামনে সমাবেশ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘চাকরিতে কোটা, মানি না, মানবো না’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জসীম উদ্দীন বলেন, কোনোভাবেই কোটা রাখা যাবে না। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্য করা যাবে না। এর জন্য যদি ছাত্রসমাজকে রাস্তায় নামতে হয়, আমরা নামাবো। আপনারা যারা উপস্থিত আছেন, সবাই এ আন্দোলনে সোচ্চার হোন।

চাকরিপ্রত্যাশী আরেক শিক্ষার্থী মুন্না বলেন, এই বৈষম্য দূর করার জন্য যদি এক মাস রাজপথে থাকতে হয়, তাহলে আমরা থাকব। তবে এই বৈষম্য দূর করেই ছাড়ব।

প্রসঙ্গত, বুধবার (৫ জুন) এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা বহালের রায় দেন। কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার ফলে এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ায় আর কোনো বাধা থাকল না। পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।

এর আগে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলনের পর সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ কোটা তুলে দিয়ে মেধারভিত্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।

 

 

এমএসআই

শেয়ার করুন:

Recommended For You