উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন বিদেশমুখী হচ্ছে    

উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন বিদেশমুখী হচ্ছে   

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। ঠিক কতো শিক্ষার্থী বিদেশে যান তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বর্তমানে দেশের চাকরির বাজারে কর্মসংস্থানের স্বল্পতা ও গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র না থাকায় দিন দিন বিদেশমুখী হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর মতে, তাদের মেধার যথাযথ কোন মূল্যায়ন হয় না এই দেশে। এদিকে বিদেশের মাটিতে ক্যারিয়ার গঠন তুলনামূলক সহজ। যার কারণে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার গড়তে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তবে উচ্চশিক্ষাকে পুঁজি করে যাতে দেশের মেধাপাচার না হয়, সেদিকে সর্তক থাকার তাগিদ শিক্ষাবিদদের।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের এ বিদেশমুখিতার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীর প্রাচুর্য, দেশে উচ্চশিক্ষার অপ্রতুল সুযোগ এবং একই সঙ্গে দেশের বাইরে পড়ার খরচ জোগাতে সক্ষম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষ। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এ শ্রেণীর বিকাশ লক্ষ করার মতো। দ্য বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের অনুমান, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণীর মানুষ বছরে ১০ শতাংশেরও বেশি হারে বাড়ছে। ফলে এ শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা ২০২৫ সাল নাগাদ ৩ কোটি ৪০ লাখে পৌঁছবে, ২০১৫ সালে যেখানে সংখ্যাটি ছিল ১ কোটি ২০ লাখ।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত আড্ডায় বিসিএস পরীক্ষা অন্যতম অনুষঙ্গ। সেসব আড্ডা-গল্পে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যাওয়া। দেশের বাজারে চাকরির স্বল্পতা, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, গবেষকদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াসহ নানা কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরলেও বেশিরভাগই স্থায়ী হচ্ছেন বিভিন্ন দেশে।

আরও পড়ুন: দুর্নীতিবাজ আর ঘুষখোরদের নাম মুখে নেয়া যেন পাপ

আন্তর্জাতিক ডিগ্রিপ্রত্যাশী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগেরই পছন্দের গন্তব্যের মধ্যে বর্তমানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, পোল্যান্ড, ইতালি ও প্রতিবেশী দেশ ভারত। সম্প্রীতি এই তালিকায় অংশ নেওয়া বাড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের মতে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একজন শিক্ষার্থী অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে বেকার থাকছেন। একদিকে বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে তীব্র প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও নানা চ্যালেঞ্জ উচ্চশিক্ষিত তরুণদের হতাশ করছে। এমন অবস্থায় সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটাতে উন্নত দেশ বেছে নিচ্ছেন তারা।

ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন

অন্যদিকে নিম্ন জীবনমান, দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তাও বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী করছে। বিদেশে পড়তে যাওয়া এসব তরুণের অধিকাংশই ধনী পরিবারের। আর তাদের পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি, যাদের অনেকেই পাঠ শেষে আর দেশে ফেরেন না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয় করছেন। এ আয় তাদের সন্তানদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে বহির্গমনে উৎসাহিত করছে। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত আয়ে তারা সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, শুধুমাত্র বিদেশ গিয়ে ফেরত না আসার কারণে নানান সময় সিন্ডিকেট সভায় অনেক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। নিয়মানুযায়ী কোনো শিক্ষক ছয় মাস বা একবছরের জন্য বিদেশে গেলে একাধিক কিস্তিতে সর্বাধিক চারবছরের জন্য ছুটিতে থাকতে পারবেন। উচ্চশিক্ষা শেষে শুধু দেশে ফিরে কাজে যোগদানই নয়, ভোগকৃত ছুটির সমপরিমাণ সময়কাল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অনেক শিক্ষকই বিদেশ যাওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন না।

বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরিতে যোগদানের জন্য মেধাবীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা বেড়েছে আগের থেকে কয়েকগুন। তবে বিসিএসও কোটার কাছে পরাজিত হচ্ছে মেধা। এদিকে সরকারি চাকরিতে আবার ৫৬ ভাগ কোটা বহাল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আবার বেসরকারি চাকরিতেও কোটা তো আছেই।এর ফলে,আপনি যত মেধাবীই হোন না কেন, চাকরি পাবেন না। আপনার চেয়ে কম মেধাবী- তার জন্য কোটা খালি থাকার কারণে চাকরি পেয়ে যাবে অনায়েশেই। এসব কারণে অনেক মেধাবী তরুণ দেশ ছাড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং, থামানোর নেই কোনো উদ্যোগ

বলতে দ্বিধা নেই, এ দেশে উচ্চশিক্ষার উন্নত পরিবেশ ও কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়া, শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মারামারি, হানাহানি, অপসংস্কৃতি ইত্যাদির কারণে শিক্ষার্থীরা দেশে পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ ছাড়া রয়েছে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে উদাসীনতা, স্বজনপ্রীতি। অভিযোগ আছে, দেশের বড় বড় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার ছাত্রসংগঠনগুলো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশের চেয়ে রাজনৈতিক পরিবেশকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেয় এবং আধিপত্য বিস্তারে অধিক মনোযোগী হয়।

 

দেশে প্রকৃত মেধাবীদের চাকরির সুযোগ, চাকরির নিরাপত্তা ও মূল্যায়ন তেমন নেই বলে উন্নত দেশে অধ্যয়নরত মেধাবীরা পড়াশোনা শেষে উন্নত দেশেই রয়ে যাওয়ার চিন্তা করে। পরিসংখ্যান করলে দেখা যাবে, এই সংখ্যা বেশ বড় এবং দিনে দিনে বাড়ছে, যা দেশকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার মতো। এই দিকটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে। এটা অপরিহার্য সত্য যে, একটি রাষ্ট্রের অন্যতম বড় সম্পদ হলো মেধা, দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানব সম্প্রদায়। আসলে যে শিক্ষার্থীরা বিদেশমুখী হচ্ছে তাঁরা কিন্তু অন্য দেশে তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সেই দেশের উন্নয়নে কাজ করছে। অথচ আমরা এই উন্নত মেধা ও যোগ্যতাকে নিজ দেশের জন্য কাজে লাগাতে পারছি না।

 

লেখক: মোঃ লিখন হোসেন, 

বার্তা সম্পাদক, ওয়ার্ল্ড গ্লোবাল২৪.কম,

সাংবাদিক ও কলাম লেখক  কলামিস্ট  

শেয়ার করুন:

Recommended For You