দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিরা অভিনবত্ব দেখিয়েছিল মানুষ খুনের পদ্ধতিতে। কীভাবে প্রচুর মানুষ একসঙ্গে কম খরচায় কম সময়ে খুন করা যায়, এ নিয়ে তারা রীতিমতো গবেষণা করেছিল। হিটলারের গণহত্যার সেই নির্মমতার সাক্ষী পোল্যান্ডের আউশউইৎজ বা ম্যাথহাউসনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বার। যেখানে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল জিকলন বি নামক হাইড্রো সায়ানাইড গ্যাস ব্যবহার করে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরাও বেছে নিয়েছিল হত্যার নানা বর্বর উপায়। জুটমিলের জ্বলন্ত বয়লারে বা অগ্নিচুল্লিতে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার কৌশল হার মানিয়েছিল গ্যাস চেম্বারের বর্বরতাকেও।
খুলনায় স্থাপিত ১৯৭১ :
গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর (সংক্ষেপে গণহত্যা জাদুঘর) তাদের নতুন ইমারতে দশ বছর পূর্তি পালন করল গত ১৭ মে। দশ বছর পর নতুনভাবে, নতুন আঙ্গিকে, গণহত্যা জাদুঘর শুরু করল পথচলা। নতুন ভবনে ঢোকার মুখেই একটি পুরোনো বয়লার। বয়লারটি আনা হয়েছে খুলনার প্লাটিনাম জুটমিল থেকে। ১৯৫৪ সালে স্থাপিত প্লাটিনামের একাত্তরে দুটি বয়লার ছিল। এই বয়লারটি তার একটি। এই বয়লারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো বাঙালিদের। প্লাটিনামসহ আশপাশের পাটকলের বাঙালি শ্রমিক, স্বাধীনতাকামী স্থানীয়দের এখানে ধরে আনত ঘাতকরা। তাদের বস্তাবন্দি করে বয়লারে প্রথম পা ঢুকিয়ে দিত এবং পা পোড়া হলে আস্তে আস্তে শরীরের বাকি অংশ ঢুকিয়ে দেওয়া হতো জ্বলন্ত বয়লারে। আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হতো পুরো এলাকা, কষ্ট দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো শরীর বয়লারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হতো বাঙালিকে।
ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন
পাকিস্তান সরকার খুলনা এলাকার শ্রমিক আন্দোলনে বাঙালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবাঙালিদের ব্যবহার করত। একাত্তরে এই বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। যুদ্ধ শুরু হলে অবাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় পুরো এলাকা। শুরু হয় ভয়াবহ নির্মমতার ইতিহাস। খালিশপুরের বিভিন্ন মিল ও শিল্পকেন্দ্র নির্যাতন কেন্দ্র, বধ্যভূমি ও জল্লাদখানায় পরিণত হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায়। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর এই অবাঙালিরা নিয়মিত বিভিন্ন পাটকলে বাঙালিদের হত্যা করে ভৈরব নদে ফেলে দিত। আর প্লাটিনামে বয়লারে বা অগ্নিচুলায় মানুষ পুড়িয়ে মারত।
আরও পড়ুন অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং, থামানোর নেই কোনো উদ্যোগ
বিভিন্ন সময়ে প্লাটিনাম জুটমিলের বয়লারে কমপক্ষে ১০০ জন বাঙালিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এর মধ্যে আমরা কয়েকজন শহীদের নাম পেয়েছি। তারা হলেন– মো. হারুন সরদার, মো. মোসলেম, হেমায়েত, হাসু মোল্যা, আজিজ, মো. আব্দুল কুদ্দুস ও আব্দুল জলিল। একাত্তরের গণহত্যার অন্যতম এই স্মারক সংরক্ষণ করা হয়েছে গণহত্যা জাদুঘরে। মিল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ও অনুমতিক্রমে বয়লারটি গণহত্যা জাদুঘরের সামনে পুনঃস্থাপিত করা হচ্ছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনই এই বয়লারটি খুঁজে বের করেছিলেন। তিনি বলেছেন, এ রকমভাবে মানুষ হত্যার কথা ‘হিটলারও চিন্তা করেননি’। এ ধরনের নিদর্শন পৃথিবীতে এই একটিই। এটি দেখে নতুন প্রজন্ম অনুধাবন করবে পাকিস্তানি সৈন্য ও শাসকদের প্রকৃতি ছিল কত জঘন্য, হিটলার থেকেও তারা ছিল কত নির্দয়। কোনো গণহত্যাকারী সভ্যতার জন্য শুভ নয়। এ বোধ থেকেই তারা শাসকদের অত্যাচার নির্মমতা, গণহত্যার প্রয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
বর্বরতা আর নির্যাতনের স্মারক হিসেবে বয়লারটি আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরছে। লাল-সবুজের এই পতাকা যে কত রক্ত আর অশ্রু দিয়ে কেনা, সেই ইতিহাস জানাতে গণহত্যা জাদুঘরের সামনে আপনার অপেক্ষায় প্লাটিনামের এই বয়লার।
লেখক:
রোকনুজ্জামান বাবুল
ডেপুটি কিউরেটর, গণহত্যা জাদুঘর, খুলনা