
বিশ্ব নদী দিবস পালিত হয় প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। কিন্তু নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় নদী দিবস থাকবে না?
নৌ নিরাপত্তাবিষয়ক সংগঠন নোঙর ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দুই দশক ধরে নৌ নিরাপত্তা দিবস ঘোষণার দাবিতে আমরা আন্দোলন করে আসছি। বিশেষ করে ২৩ মে তারিখকেই জাতীয় নদী দিবস ঘোষণার কথা বলে আসছি। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আমাদের বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যেহেতু সরকারিভাবে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করা হয়ে থাকে, তাই আরেকটি নৌ নিরাপত্তা দিবস পালন কারিগরিভাবে কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে, ২৩ মে তারিখকে তাহলে আমরা কি স্মরণ করব না?
আমাদের মনে আছে, ২০০৪ সালের ২৩ মে রাতে চাঁদপুরের কাছে মেঘনাসহ বিভিন্ন নদীতে চারটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায়। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে চাঁদপুরে ঝড়ের কবলে পড়া ‘এমভি লাইটিং সান’ লঞ্চের যাত্রী ছিলেন আমার মা আছিয়া খাতুন। ওই রাতেই এমভি দিগন্ত ও এমএল মজলিশপুর নামে আরও দুটি লঞ্চ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আমার মাসহ তিন শতাধিক যাত্রী ওই রাতে প্রাণ হারান। কিন্তু সেটাই লঞ্চ ডুবে প্রাণহানির শেষ ঘটনা ছিল না। গত দুই দশকে আরও অনেক প্রাণ হারিয়ে গেছে নদীতে।
ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চল বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই নদীমাতৃক এ দেশের নৌপথ সহজ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। অথচ সেই নৌপথে মৃত্যু আতঙ্ক যেন যাত্রীদের সঙ্গেই ঘোরে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে রাজধানী ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন দুই লাখ যাত্রী নৌপথে যাতায়াত করে থাকে। তখন আমরা এক আতঙ্কিত সময় পার করি। কারণ আবার কোথাও কোনো নৌডুবি হবে না তো?
নদীমাতৃক দেশ, অথচ এ দেশের নদ-নদীর বুকে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন আমাদের রাষ্ট্রীয় অবহেলা আর ব্যবসায়ীদের অতিলোভের কারণে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের নৌপথ সবার অবহেলার একটি পথ! যে নদীগুলো বাংলাদেশকে মায়ের মমতা দিয়ে বুকে ধারণ করছে, সেই মায়ের বুকে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে মুষ্টিমেয় লোক। নৌপথ নিরাপদ না হলে নদীমাতৃক দেশও নিরাপদ হবে না। কারণ এই নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশপ্রেম, মায়ের মমতা।
মনে আছে, এমভি পিনাক লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক সভায় নদী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নদী নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলেছিলেন তিনি। তিনি যথার্থই বলেছিলেন, ঝড়ের সময় যাত্রীবাহী নৌযান কীভাবে টিকে থাকবে– সে বিষয়ে চিন্তা না করে বেশি বেশি লাভের জন্য বেশি বেশি কেবিন বানানো, বেশি করে যাত্রী ওঠানোর কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এমনভাবে নকশা করতে হবে যেন নৌযান নদীতে না ডোবে।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে– এমনটি বলা যাবে না। নৌ দুর্ঘটনাও থেমে নেই। এখনও আমরা একটি জাতীয় নৌ নিরাপত্তা দিবস ঘোষণার দাবিতে প্রতিবছর আন্দোলন করি। অব্যবস্থাপনার কারণে নদীতে নিহত সবার স্মৃতির উদ্দেশে একটি জাতীয় নৌ নিরাপত্তা দিবস ঘোষণা সত্যই জরুরি।
আরও পড়ুন অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং, থামানোর নেই কোনো উদ্যোগ
অনেকেই জানেন, গত দুই দশকে ‘নোঙর’ এ দেশের নৌপথ নিয়ে অনেক কথা বলেছে; অনেক যাত্রীকে সচেতন করেছে এবং সরকারকে সচেতন করতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে নদী সুরক্ষায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগে নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা; দূষণমুক্ত করার কাজ; নৌপথকে নিরাপদ যাত্রীবান্ধব করার চেষ্টা এবং নোঙরের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছেন উচ্চ আদালত। যে কারণে দেশের সর্বসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে; মায়ের মমতার মতো নদীর প্রতি যত্নশীল হয়েছে।
আমরা এখন চাইব, কারিগরি কারণে ২৩ মে যদি নৌ নিরাপত্তা দিবস ঘোষণা করা সম্ভব না হয়, তাহলে একে জাতীয় নদী দিবস ঘোষণা করা হোক। কারণ নদীর নিরাপত্তা শুধু যাত্রী ও পরিবহনের বিষয় নয়; নদীর নিরাপত্তার সঙ্গে নদীর সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। দখল- দূষণ, বালু উত্তোলন, অপরিকল্পিত স্থাপনা, প্রবাহস্বল্পতামুক্ত নদীই হচ্ছে নিরাপদ নদী। ২৩ মে জাতীয় নদী দিবস ঘোষণা করা হলে নদীর সার্বিক ও সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রশ্নটি আরও জোরালো হবে।
লেখক: সুমন শামস
চেয়ারম্যান, নোঙর ট্রাস্ট