
সাতক্ষীরায় যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থানীয় কারিগরি ও বৃত্তিমুলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছ।
বৃহস্পতিবার (১৬ মে) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সাতক্ষীরা শহরের উপকণ্ঠে মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট-এর অডিটোরিয়ামে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি’র উদ্যোগে ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ইএসডিও’র সার্বিক সহযোগিতায় সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়। সিপিডির ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে সংলাপে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আশরাফুজ্জামান আশু, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম, ৩১৩, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লায়লা পারভীন সেঁজুতি।
সংলাপে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও কারিগরি) মঈনুল ইসলাম মঈন,সিপিডির ফেলো ও কোর গ্রুপ সদস্য অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান, মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন,সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা শিক্ষা অফিসার শাহজাহান কবির,টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফেরদৌস আরেফীন, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মহানন্দ মজুমদার,জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এছমত আরা বেগম, দৈনিক দক্ষিণের মশাল পত্রিকার সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী, সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার, জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শিমুন শামস্, ফারহা দিবা খান সাথী, গাজী ইমরান, ইমান আলী, শ্যামল বিশ্বাস, কাজী আল হেলাল, প্রিয়াংকা বিশ্বাস, উম্মে সালমা প্রমুখ।
সিপিডি সংলাপে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। বাংলাদেশে সরকারি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন তুলে ধরেন তিনি। সংলাপে জেলার জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, চেম্বারের প্রতিনিধি, উদ্যোক্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেন। এছাড়া সাতক্ষীরা জেলার বিশিষ্টজনেরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে সাতক্ষীরা কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা,দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণের অভাব, অভিভাবকদের অসচেতনতা, প্রচার প্রচারণার অভাব, আন্তরিকতার ঘাটতি, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও তার ফলোআপ না করা,উদ্যোক্তাদের পুঁজির অভাব,সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, বাজার অনুযায়ী ট্রেড গঠন না করা, শিক্ষার আধুনিকায়নের অভাব, বাজেটে বরাদ্দ কম দেয়াসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।
পরে কারিগরি শিক্ষাকে একটি অন্যতম অগ্রাধিকার খাত হিসেবে সরকারিভাবে কার্যকর স্বীকৃতি দেয়া, স্বল্প মেয়াদী কোর্সের চাইতে দীর্ঘমেয়াদি এবং কর্ম চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্সের উপর জোর দেয়া, চলমান পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষা বাজার উপযোগিতার সাথে সমন্বয় করা, দক্ষ জনবল নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি হাতে কলমে শিক্ষার উপর জোর দেয়া, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ ও পাঠদানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নারীদের জন্য কারিগরি শিক্ষায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, পুঁজিহীন উদ্যোক্তাদের সনদকে অন্যতম বিবেচনায় ঋণ সরবরাহ করা, কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের মাঝে তৈরি হওয়া ধারণা বদল করতে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো, দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে সাতক্ষীরা জেলার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পর্যটনসহ কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়াসহ চাকরিতে কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করলে দক্ষ জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করা যাবে বলে মতামত দেন বক্তারা।
বক্তারা সাতক্ষীরার সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন, মৎস্য, চিংড়ি, কাঁকড়া, কৃষি, বনায়ন, নার্সারী, আম, কুল, মোম ও মধুসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। এছাড়া বিদেশের শ্রমবাজারে সাতক্ষীরার মানুষের অবদানের কথাও তুলে ধরেন। সংলাপে সংসদ সদস্য আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, সাতটি উপজেলা ও দুটি পৌরসভা নিয়ে সাতক্ষীরা গঠিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকেই সাতক্ষীরা অবহেলিত। ১৯৮৪ সালে মহাকুমা থেকে জেলায় রূপান্তর হয় সাতক্ষীরা। এরপরে সাতক্ষীরায় বিসিক শিল্প নগরী গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠিত হয় সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ নামে একটি বস্ত্র কল। যা পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। জেলায় ভারী কোন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংকট রয়ে গেছে। সরকার কর্মমুখী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সাতক্ষীরার ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলায় বিশ্ব মাতাচ্ছে।খেলাধুলায় এ জেলায় নারী জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। জেলায় দুটি স্থলবন্দর আছে।একটি চালু আছে অন্যটি অতি দ্রুত চালু হবে। জেলার অনেকেই বিদেশে চাকরি করে।অনেক নারী বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাতক্ষীরার অনেক ভূমিদস্যু সরকারি জমি দখল করে রেখেছে। ভূমিদস্যুদের কব্জা থেকে সরকারি জমি উদ্ধার করতে পারলে তা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। সুন্দরবনের মৎস্য ও মধু আহরণকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা অনেক উপকৃত হবে।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো.নজরুল ইসলাম বলেন, ১০ ব্রিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আমাদের চলে যাচ্ছে বাইরে দক্ষ জনবলের অভাবে। দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। অদক্ষ জনশক্তি বিদেশে যাওয়ার কারণে তারা ন্যায্য মজুরি পায়না। ফলে কাঙ্ক্ষিত রেমিটেন্স আসেনা। এজন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবার আগের দূর করতে হবে ভাষার দেওয়াল।ভাষা না জানার কারণে আমাদের দেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে কম বেতন পায়।স্থানীয় কৃষিকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। তবেই সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। আর্থ-সামাজিক যেকোন উন্নয়নমূলক কাজে নারীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে হবে। পেশার মূল্যায়ন করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দেয়াসহ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর আহ্বান জানান তিনি।
সাংসদ লায়লা পারভীন সেঁজুতি বলেন, ঘরে বসে থাকার কারণে সরকারের নানা উন্নয়নমূলক উদ্যোগের কথা জনগণ জানতে পারেনা। জনগণকে সরকারের উদ্যোগের কথা জানাতে হবে। র্যালি ও আলোচনা সভার মধ্যে সরকারের উদ্যোগ সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। বেশি করে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে যাতে মানুষ প্রত্যেকটি প্রকল্পের সুফল পায়। নারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ঘরে বসে থাকলে কেউ কর্ম খুঁজে দিবে না। নিজেদেরকে আত্মনির্ভর করে গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
সিপিডি’র ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ এখন উত্তরণকালীন সময়ের মধ্যে আছে। মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা আগামী দিনে যে নতুন ধরণের প্রযুক্তিগত বিপ্লব আসছে তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারিগরি দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী, আমাদের নারীদের এখানে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে জরুরি কারিগরি শিক্ষার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভঙ্গি উন্নত করা। এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা না বদলাই তাহলে বাংলাদেশের আগামী দিনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে আমরা এক ধরণের প্রতারণা করব। এজন্য কারিগরি শিক্ষার জন্য সরকারের যেসব প্রচেষ্টা রয়েছে তা সেগুলোকে আরও আধুনিক ও উন্নত করা, তার জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, শিক্ষকদের আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং একই সাথে বহুমুখী যেসব শিক্ষা চলছে সেগুলোকেও এই দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এই সংলাপে উঠে এসেছে আগামী দিনে বাংলাদেশ গড়তে হলে, দক্ষ জনশক্তি গড়তে হলে এই মানুষগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। দেশের উত্তর অঞ্চল, দক্ষিণ অঞ্চল ও হাওড় অঞ্চলের মানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় করে বেকারমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকার পদক্ষেপ নিবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।