সামেক হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা থেকে বঞ্চিত হবে রোগীরা

মেশিন নষ্ট হওয়ায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা থেকে বঞ্চিত হবে একশ’ কিডনি রোগী। এরফলে যেকোন সময় মৃত্যু হতে পারে শতশত কিডনি রোগির। ডায়ালাইসিস সেবা সপ্তাহে একবারের ঘোষণা দেওয়ায় মৃত্যুর আতঙ্কে ভুগছে শতশত রোগী।
স্থানীয় সাংবাদিক জহুরুল কবীর জানান, আমার স্ত্রীকে সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয়। জমিজমা সহায়-সম্পদ বিক্রি করে কিডনি আক্রান্ত স্ত্রীকে চিকিৎসা করিয়ে আসছি। ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা কারনোর মতো সক্ষমতা আমার নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সপ্তাহে তিন সেশনে ১২ঘন্টা করে নেওয়া কথা থাকলেও মেশিন সল্পতা ও রোগীর চাপের কারণে দুটি সেশনের ৪ঘন্টা করে সপ্তাহে ৮ ঘণ্টা করে নেওয়া হয়। এমতাবস্থায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতাল থেকে মোবাইল ফোনে জানানো হয়েছে বুধবার থেকে সপ্তাহে একবার কিডনি আক্রান্ত রোগিদের ডায়ালাসিস করানো হবে। সপ্তাহে ৪ঘন্টা নেওয়া হলে অধিকাংশ রোগী টিকবে না।
খবরটি শুনে তিনি ডুকরে কেঁদেছেন। এ যেন জীবন মৃত্যুর খবর। স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য তিনি জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বর্তমান  হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার শীতল চৌধুরী যোগদান করেছেন প্রায় দুই বছর হতে গেল। তিনি যোগদানের পর থেকে বিষয়টি তাকে এই সমস্যার কথা বলা হলেও তিনি বিষয়টি না গুরুত্ব দেননি। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালে কিডনি রোগিদের জন্য ডায়ালিসিস সেবা চালু রাখতে তিনি সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
মহিউদ্দিন, ব্রোজেন, জয়নালসহ কয়েকজন রোগী বলেন, শতরোগীর জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বন্ধপ্রায় সামেক হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট। মঙ্গলবার ডায়ালাইসিস ইউনিট ইনচার্জ নমিতা রানী রোগীদের ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন বুধবার থেকে সপ্তাহে দু’টির পরিবর্তে একটি ডায়ালাইসিস করানো হবে। এব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, ১৯টি মেশিনের মধ্যে মাত্র দু’টি জোড়াতালি দিয়ে চলছে। তাই সপ্তাহে আর দুই অথবা তিনবার ডায়ালাইসিস দেওয়া হবে না। এটি পরিচালকের সিদ্ধান্ত।
রাবেয়া, আসমাসহ কয়েকজন রোগী অভিযোগ করে বলেন, পরিচালককে দীর্ঘ দেড় থেকে দুই বছর যাবৎ মেশিন মেরামতের কথা বলে আসলেও তিনি ‘চেষ্টা করছি’ বলে পরিচালকের রুম থেকে বের করে দেন।
সদরের ফিংড়ির একজন রোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমরা গত জানুয়ারি মাসে যখন মাত্র চারটা মেশিন চালু ছিলো তখন আমরা ক’জন রোগী নিয়ে পরিচালকের নিকট গেলে তিনি আমাদের ধমক দিয়ে বলেন, এখানে ঝামেলা করেন না, বাইরে যান। এরপর বের করে দেন। তিনি আরও বলেন, খুলনায় আবু নাসের হাসপাতালে যান। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার নরমল স্যালাইন শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের সপ্তাহে একটি করে ডায়ালাইজার ও একটি করে ব্লাডলাইন রিফিলকৃত (ওয়াশকৃত) নিতে হয়। এছাড়া রক্তের ইনজেকশন ইপোটিন (ইথ্রোপোয়েটিন), বি-ক্যান ফ্লুইট, সিরিঞ্জ ইত্যাদি কিনতে হয়।
এরই মধ্যে মঙ্গলবার ডায়ালাইসিস ইউনিট ইনচার্জ নমিতা রানী ফোন করে জানান, বুধবার থেকে সপ্তাহে একটি করে ডায়ালাইসিস দেওয়া হবে। এখন মৃত্যু ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। সাংবাদিকের কাছে কাঁদতে কাঁদতে শ্যামনগর বংশিপুরের আজিজ মোড়লের পুত্র জয়নাল (৩০) জানান, ‘আমার মা গ্রামে গ্রামে ও হাট-বাজারে ভিক্ষে করে আমার ডায়ালাইসিস খরচ চালায়। এখন যদি এখানে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয় তাহলে যেকোন সময় আমার মৃত্যু হবে। কারণ প্রাইভেটে ডায়ালাইসিস করানোর সামর্থ আমার নেই।’
অপর একজন রোগী নলতার ময়নুদ্দিনের পুত্র মহিউদ্দীন (৩০) জানান, ‘বুধবার আমার ডায়ালাইসিসের দিন কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলেছে আগামী রবিবার আসতে। আর এবার থেকে সপ্তাহে একবার ডায়ালাইসিস দেওয়া হবে। এখন আগামী রবিবার পর্যন্ত যে বাঁচবো এর নিশ্চয়তা নেই। আজই তাই আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ডায়ালাইসিসের আগের দিন এমন হয়। কারণ শরীরে পানি বেড়ে যায়। রক্তে ক্রিটিনাইন ও পটাশিয়াম বেড়ে যায়। এখন যে ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস নেব তারও তো পয়সা নেই। আমি অসুস্থ হওয়ায় বউ সারারাত অর্ডারি প্রতি পিছ পাঁচ টাকা হারে ব্যাপারির নতুন মশারি সেলাই করে যে টাকা কামাই করে তাই দিয়ে আমার সংসার ও চিকিৎসা ব্যয় চালানো হয়। এখন ক্লিনিকে গেলেই পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হবে। এতো টাকা কোথায় পাবো?’
এব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা মেডিক্যাকল হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার শীতল চৌধুরী জানান, অদক্ষ ব্যক্তি দ্বারা মেশিন পরিচালনা করায় সব মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মোট কতটা মেশিন আছে আর নষ্ট মেশিনের সংখ্যা কত জানতে চাইলে সম্ভবত আমাদের মোট ডায়ালাইসিস মেশিন ১৯টি যার মধ্যে বর্তমানে তিনটি সচল আছে। নষ্ট মেশিনগুলো মেরামত প্রক্রিয়া কোন পর্যায়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘এটাতো দীর্ঘ প্রসেসের ব্যপার মন্ত্রনালয়ে জানানো হয়েছে মেরামতের জন্য কয়েক দফায় টেকনিশিয়ানও এসেছে কিন্তু খুচরা যন্ত্রাংশ না পাওয়া যাওয়ায় ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দ্রুত মেরামত করার চেষ্টা করছি।’
শেয়ার করুন:

Recommended For You