ভৈরবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য পোস্টার-ব্যানারের দখলে

ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয় স্থানীয় ১২ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে। ভাস্কর্যের এক পাশে এর একটি নামফলক রয়েছে। পোস্টারে ওই অংশটুকুও ঢাকা পড়েছে। ঢাকা পড়েছে ভাস্কর্যের সৌন্দর্য। নির্বাচনী পোস্টারে দুর্জয় ভৈরব ভাস্কর্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছেয়ে আছে। সাঁটানো পোস্টারে বড় অংশ আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সম্ভাব্য চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের। ভোটারদের কাছে দোয়া চেয়ে নিজেদের প্রার্থিতা জানান দিতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের এই প্রচারণা।

ভাস্কর্যটির এক পাশ দিয়ে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। আরেক পাশ স্পর্শ করে গেছে ভৈরব- ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়ক। ২০০০ সালের ১৭ এপ্রিল ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। এই দুই মহাসড়কের যাত্রীদের কাছে ভৈরবকে চেনানোর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এই ভাস্কর্য। এককথায় প্রতিদিন লাখো মানুষ ভাস্কর্যে চোখ রেখে ভৈরব অতিক্রম করে। মূলত এ কারণে যেকোনো প্রচারে ভাস্কর্যটি এক শ্রেণি মানুষের আগ্রাসনের শিকার হয়ে আসছে।

ভাস্কর্যের পাশের এক দোকানি আক্ষেপ করে বলেন, যাঁদের পোস্টার লাগানো হয়, তাঁরা সমাজের সচেতন মানুষ হিসেবে পরিচিত। আবার যাঁরা সচেতন লোকদের প্রতিনিধি হয়ে লাগাতে আসেন, তাঁরা কারও বাধা মানতে রাজি নন। বেশি কিছু বলতে গেলে উল্টো ঝামেলায় জড়ানোর আশঙ্কা বেড়ে যায়। ফলে চোখের সামনে ভাস্কর্যের সৌন্দর্যহানী হলেও কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।

মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে নির্মিত ‘দুর্জয় ভৈরব’ ভাস্কর্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের এক প্রার্থীর পোস্টার সাঁটাতে আসেন কয়েকজন তরুণ। শহীদ স্মৃতি ভাস্কর্যে পোস্টার সাঁটানোর কারণ জানতে চাইলে এক তরুণের তীর্ষক উত্তর, ‘অন্যরা লাগিয়েছে, আমরাও লাগাব।’ এই সময় সঙ্গে থাকা আরেক তরুণ বিনয় রেখে বলেন, ‘অন্যরা না লাগালে তো আর আমাদের লাগাতে হতো না।’ পরে তাঁরা একটি পোস্টার সাঁটিয়ে চলে যান।

এই ভাস্কর্যের সামনে রাত ১২টা ১ মিনিটে তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় ও স্বাধীনতার দিবসের সূচনা হয়। ভৈরবের সর্বস্তরের মানুষ ‘দুর্জয় ভৈরব’ পাদদেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে জাতীয় দিবস উদ্যাপন করে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটির পবিত্রতা রক্ষায় দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। পোষ্টার সাঁটালেও বাধা নেই। ভাস্কর্যের রক্ষণাবেক্ষণের দায় নিয়ে রয়েছে সরকারের একাধিক বিভাগের মধ্যে ঠেলাঠেলি।

ভাস্কর্যটির এমন বেহাল, বিব্রত ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খানও। তিনি বলেন, ভাস্কর্যটি স্পর্শকাতর। কারণ, এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ জড়িত। কিন্তু এখন ভাস্কর্যের সৌন্দর্য নষ্টে প্রতিযোগিতা চলছে। ভাস্কর্যের সৌন্দর্য রক্ষায় প্রতিকারে উদ্যোগী হবেন কি না, এমন প্রশ্নে ইউএনও জানালেন, এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌরসভার। তবে পৌর কর্তৃপক্ষ ইউএনওর কথার সঙ্গে একমত নয়।

মেয়র ইফতেখার হোসেন বেনু বলেন, ‘এই ভাস্কর্যে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে প্রথম পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে উপজেলা পরিষদ। আমাদের দায়িত্ব কেবল বিশেষ দিনে রং করে দেওয়া। এর বাইরে আর কোনো দায়িত্ব আমাদের নেই। এই চত্বরের পাশে ২৪ ঘণ্টা পুলিশের সদস্যরা অবস্থান নিয়ে থাকেন। চাইলেও তাঁরা পোস্টার লাগানোর সময় বাধা দিতে পারেন, কিন্তু তাঁরা দেন না।’

বিষয়টি নজরে এনে জানতে চাওয়া হয় ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সফিকুল ইসলামের কাছে। ওসির প্রথম মন্তব্য হলো, ভাস্কর্যে যা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অরুচিকর। পরে বলেন, শহিদদের সম্মান জড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটিকে এমন হালে ফেলে রাখা যাবে না। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে পোস্টার সরাতে হবে এবং স্থায়ী সমাধানের উপায় বের করতে হবে। এই বিষয়ে পুলিশ উদ্যোগী থাকবে।

শেয়ার করুন:

Recommended For You