লক্ষ্মীপুরের সয়াবিন চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা

সয়াল্যান্ড খ্যাত লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এবার। সেই সাথে কৃষকের মুখে ফিরেছে হাসির ঝলক। তারা আশা করছেন এবার সয়াবিনের ন্যায্য দামই পাবেন। বিগত দুই-তিন বছর আগাম বৃষ্টির কারণে কাঙ্খিত ফল না পেলেও এবার সয়াবিনের ভালো ফলন হতে পারে বলে জানান কৃষকরা। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে সময়মতো শস্য ঘরে তুলতে পারবেন বলে তারা আশাবাদী।

কৃষি বিভাগ বলছে, এ মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলায় যে পরিমাণ সয়াবিন উৎপাদিত হবে তার বাজারমূল্য প্রায় সাত শ’ কোটি টাকার মতো হবে। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, সারা দেশে যে পরিমাণ সয়াবিন উৎপাদিত হয় তার ৭০-৮০ শতাংশই উৎপাদিত হয় লক্ষ্মীপুরে। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকার মাটি ‘সয়াল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত। জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চল এবং রায়পুর, রামগতি ও কমল নগর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সয়াবিন চাষ হয়। নদীমাতৃক হওয়ার মেঘনার বিভিন্ন চরেও এখন ফলানো হচ্ছে সয়াবিন।

কৃষকরা জানায়, ধান বা অন্য কোনো ফসলের চেয়ে সয়াবিনে লাভ বেশি। গত কয়েক বছর ধরে ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন। তবে সয়াবিনের বীজ, সার, ওষুধ ও শ্রমিক খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। এ অঞ্চলের জমি উর্বর থাকায় সয়াবিন তোলার পর পরই সেই জমিতে ধান চাষ করা যায়। এতে ধানের ফলনও বেশ ভালো হয়।

প্রতি একরে ফলন হয়েছে ৫০-৫৫ মণের মতো। সদর উপজেলার চররমনী মোহনের এক কৃষক বলেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে সয়াবিন চাষে খরচ কম হয়। তাই কৃষকরা রবি মৌসুমে সয়াবিন চাষাবাদে বেশি আগ্রহী হন। আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে সয়াবিনের বীজ লাগানো যায়। সয়াবিন চাষাবাদে অন্যান্য ফসলের চেয়ে সার ও ওষুধ কম লাগে। রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গত বছরের তুলনায় এবার সয়াবিনের বাম্পার ফলন হবে। এতে কৃষকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে। প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা ও বাজারজাতের নিশ্চয়তা পেলে কৃষকরা সয়াবিন চাষে আরো আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আশার কথা হলো, সয়াবিন চাষ করলে ওই জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে কৃষকরা সয়াবিন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

লক্ষ্মীপুরে ৪২ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে চলতি মৌসুমে তেলবীজটির উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৮০ হাজার ৭৯৮ টন। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদনের পরিমাণ পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষকরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস ও অতিবৃষ্টির কারণে ফসল হানি ঘটে। তবে ২০২২-২৩ বিপণন বছরে সয়াবিনের ভালো ফলন এসছে। গত মৌসুমে ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় এবারো সয়াবিন আবাদে আগ্রহী হয়েছেন চাষীরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ বিপণন বছরে ৪১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ৮৩ হাজার ২০০ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ২০০ টন। কৃষি বিভাগ বলছে, উচ্চফলনশীল নতুন জাতের বিইউ-১, বিইউ-২, বারি-৫ ও ৬, বিনা-৫ ও ৬ জাতের সয়াবিন চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন কৃষকরা। বিদায়ী মৌসুমে ১২০০ কোটি টাকার বেশি সয়াবিনে বাণিজ্য করেছেন চাষীরা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তেলবীজটির উৎপাদন আরো বাড়াতে কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, বছরে দুবার সয়াবিন উৎপাদন করেন লক্ষ্মীপুরের চাষীরা। প্রথমবার আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সয়াবিন বীজ আবাদ করা হয়, যা খরিপ-২ মৌসুম নামে পরিচিত। দ্বিতীয়বার পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে মাঘ মাসের শুরুর দিকে কৃষকরা রবি শস্য হিসেবে সয়াবিনের আবাদ করেন। উৎপাদিত সয়াবিন বীজসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়। রায়পুর উপজেলার টুনুর চর, চর ঘাষিয়া, চর কাচিয়া, কানিবগার চরে সয়াবিন বীজ উৎপাদন করা হয়। এখানকার বীজ উন্নত মানের হওয়ায় অন্যান্য জেলার কৃষকরাও এখানে বীজ কিনতে আসেন।

খরিপ-২ মৌসুমে প্রায় চার হাজার টন সয়াবিন বীজ উৎপাদন হয়, যার টনপ্রতি আনুমানিক বাজার মূল্য ২ লাখ টাকা। এ হিসাবে চার হাজার টন সয়াবিন বীজ থেকে স্থানীয় বাজারেই লেনদেন হয় প্রায় ৮০ কোটি টাকা। আর রবি মৌসুমে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয়। এ মৌসুমে প্রতি মনে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পান কৃষকরা। জেলাজুড়ে সয়াবিন লেনদেন হয় প্রায় ৬০০ কোটি টাকার।

কমলনগর হাজিরহাট এলাকার সয়াবিনচাষী নুর উদ্দিন বলেন, ‘সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া’ নামে একটি সংস্থার সহায়তায় ‘নারিশ’, ‘আফতাব’ ও ‘এগ্রিগেইট’সহ বিভিন্ন ফিডস মিল কোম্পানি খেত থেকেই উৎপাদিত আগাম কিনে নেয়। এ কারণে আমরা ভালো দাম পেয়েছি গতবছরে। আর বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কয়েকজন গবেষক মাঠ পর্যায়ে উন্নত জাতের বিইউ-২, ৩, ৪ জাতের সয়াবিন বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে। তাছাড়া কৃষি কর্মকর্তারা আমাদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন।’‌ তিনি জানান, ধান কাটার পর পরই সয়াবিন চাষের জন্য ক্ষেত তৈরি করবেন। এজন্য তারা সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ রেজাউল করিম ভূঁঞা বলেন, ‘‌লক্ষ্মীপুরের পাঁচ উপজেলার মধ্যে রায়পুর, রামগতি, কমলনগর ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় বেশি পরিমাণে সয়াবিন আবাদ হয়। বর্তমানে জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু সয়াবিন উৎপাদনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ড. খালেদ কমলনগর উপজেলায় কিছু নতুন জাতের সয়াবিন ট্রায়েল ফলক বসিয়েছেন। ট্রায়েল ফলকটি পানিসহিষ্ণু সফল হলে জাতটি আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে বলে জানান তিনি।

১৯৮২ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সয়াবিনের চাষ করে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) নামে একটি সংস্থা। উৎপাদন উপযোগী উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়ায় প্রথমবারেই উৎপাদনে বেশ সাফল্য আসে। দেশে মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশই আসে লক্ষ্মীপুর থেকে। উৎপাদিত সয়াবিন পোলট্রি খাদ্য, ফিশ ফিড, সয়া নাগেট, সয়াবিস্কুট, সয়ামিট, সাবান, সয়াদুধ, শিশু খাদ্যসহ ৬১টি ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য ও পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয় বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক ড. জাকির হোসেন বলেন, সয়াবিনের উৎপাদন বাড়াতে আমরা কৃষকদের সঠিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এবার ফলন ভালো হয়েছে। বর্তমানে কেজি-প্রতি সয়াবিনের দাম ৫৫-৬০ টাকা। সে হিসাবে এ জেলায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সয়াবিন উৎপাদিত হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত সয়াবিন দিয়ে পশু ও মাছের খাদ্য তৈরি হয়। ফলে বিভিন্ন ফিড কোম্পানির কাছে সয়াবিনের ভালো চাহিদা রয়েছে। তারা কৃষকদের কাছ থেকে সয়াবিন কিনে নিচ্ছেন। জেলার এ কৃষি কর্মকর্তা বলেন, সয়াবিনের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদেরকে উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিড) জাতের বীজ সারিবদ্ধভাবে বপণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হাইব্রিডের মধ্যে বিইউ-১, বিইউ-২, বারি-৬, বীনা-৫ ও বীনা-৬ জাতের সয়াবিন রয়েছে। এগুলোতে ফলন ভালো হয় এবং সময়কালও কম থাকে। বিইউ-১ জাতের সয়াবিন রোপণের পর ফলন আসতে মাত্র ৮০ দিন সময় লাগে। যেসব সয়াবিনে সময়কাল কম, সেগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে না।

শেয়ার করুন:

Recommended For You