পূর্বে উচু নিচু পাহাড় ও পশ্চিমে সমুদ্র বিস্তৃত নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অন্যতম জনপথটির নাম বাঁশখালী উপজেলা।
বাঁশখালী নামের উৎপত্তি:
সাগরের তীরবর্তী হাওয়ায় এই উপজেলাটি ছিল প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক বিচিত্র অধ্যায়। ঐতিহাসিক এই বাঁশখালী নাম করণ সম্পর্কে দক্ষিণ চট্টলার ইতিহাসবিদ প্রফেসর ডঃ আব্দুল করিম ইতিহাস ও ঐতিহ্য বইয়ে চারজন কিংবদন্তের কথা উল্লেখ করেছেন। সাতকানিয়া উপজেলার মাওলানা শরফ উদ্দিন বেহাল (রা) এর মূতুর পর বাঁশখালী নামটি প্রচলন হয়েছিল বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। এছাড়াও ইংরেজ শাসন আমলের রাজস্ব আদায়ের দলিল-দস্তবেও বাঁশখালী নামটি পাওয়া যায়। ১৪২৯ সালের পর থেকে এই অঞ্চলটি আরকান শাসনের অধীনে ছিল। পরবর্তীতে ১৫২৫ সালের দিকে নুসরাত শাহ আরকানদের হাত থেকে এই অঞ্চলটি মুক্ত করেন। এবং পরবর্তীতে গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ ক্ষমতা হাতে নেন ১৫৩৮ সালের দিকে। সে সময় বাঁশখালী উপজেলাটি চকরিয়ার অংশ ছিল। উপজেলাটির উত্তর সীমানায় সাঙ্গু নদীর জল প্রবাহ থেকে শুরু করে উপজেলার সারা এলাকা জুড়ে বয়ে গেছে ডাল পালার মতো নানান শাখা-প্রশাখা।
বাঁশখালীর আয়তন ও জনসংখ্যা:
পরবর্তীতে ১৯১৭ সালের ১৫ জুলাই বাঁশখালী থানা গঠিত হয় এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে।৩৭৬.০৯ র্বগ কিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ১৪ টি ইউনিয়ন সমন্বয়ে একটি বিশেষ উপজেলা বাঁশখালী।২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বর্তমানে উপজেলাটির মোট ৪,৩১,১৬২ জন অধিবাসীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে বাঁশখালী থানার ১৪২ জন পুলিশ সদস্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঁশখালীর মানুষের ভূমিকা:
এছাড়াও বাঁশখালী উপজেলায় রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক নির্মম ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৯ মে পাকবাহিনী ৭৫ জন নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাছাড়া জলদী, বাণীগ্রাম ও কালীপুরে বেপক লুটপাট ও অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং অক্টোবর মাসে পাকবাহিনী বাঁশখালীর দক্ষিণ প্রান্তে নাপোড়া গ্রামে ৮৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। এর জবাবে মুক্তিযুদ্ধারা দমে না গিয়ে বাঁশখালী অপারেশন পরিচালনা করেন তারাই ধারাবাহিকতায় ১৪ ডিসেম্বর মুক্তি ও মৃত্যু বাহিনীর যত আক্রমনে বাঁশখালী এলাকা হানাদার মুক্ত হয়। সেইসব ভয়াবহ স্মৃতির চিহ্ন হয়ে আজও ঠিক আছে দুইটি বৌদ্ধভূমি ও একটি গণকবর।
ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান:
উপকূলীয় বাঁশখালী উপজেলা নানান ধর্ম ও পেশার মানুষের সম্প্রতিতে ভরপুর। তাই অঞ্চলটিতে আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মালেকা বানুর মসজিদ,৪৫০ বছরের বেশি পুরনো বখশী হামিদ মসজিদ,কাতেবী জামে মসজিদ,নবী মসজিদ ,সরল্যার মসজিদ, ইত্যাদি। ইসলামি পুরাকীর্তি ছাড়াও বাণীগ্রামের শিক মন্দির, গির্জা, অদ্বৈতনন্দন মহারাজ আশ্রম, গুনাগরী দিশারী ক্যাম্প বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জ্ঞানসমূহ বাঁশখালীর সম্প্রদায় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান:
বাঁশখালী পর্যটকদের কাছে অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। বাঁশখালী পর্যটক হিসেবে যে স্থান গুলো জায়গা করে নিয়েছে।সু-দীর্ঘ ৩৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত,শীতকালে অতিথি পাখিদের কোলাহলে মুখরিত পাহাড় আর কৃত্রিম জলসয়ে অভুত পূর্ব নিচু প্রকৃতির বনভূমি বাঁশখালী ইকোপার্ক, চির সবুজের বিশাল বিচরণ ক্ষেত্র বাঁশখালী চাঁদপুর বেলগাঁও চা বাগান,জলদী সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জলকদর খাল,উপকূলের লবণ মাঠ,সরল্যার দীঘি, সহ বহু প্রকৃতিক সৌন্দয়ের নিদর্শন রয়েছে এই উপজেলায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:
বাঁশখালী উপজেলায় ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৩টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ও ৩টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও থানা ভবনের সামনে রয়েছে বাঁশখালী প্রেসক্লাব।এ উপজেলায় ৩টি ডিগ্রী কলেজ, ৭টি ফাজিল মাদ্রাসা, ২টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, ১টি কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৪টি আলিম মাদ্রাসা, ২৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৪টি দাখিল মাদ্রাসা ও ১৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ মৌসুমী ফল:
বাঁশখালীর ঐতিহ্য হিসেবে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বাঁশখালীর পান। বাঁশখালী সাধনপুর, কালিপুর, বলিছড়ি, পুইছড়ি ইউনিয়নে পাহাড়ি এলাকায় পানের বরজ রয়েছে। স্বাদে গুনে অনন্য বাঁশখালীর পানের কদর রয়েছে সারাদেশ জুড়ে। তাছাড়া বাঁশখালী কালিপুরের লিচু সারাদেশে জুড়ে প্রসিদ্ধ। কালিপুর ছাড়াও জলদি, চাম্বল, নাপোড়া কিছু অংশে বেপক লিচুর চাষ হয়ে থাকে।
এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা ও আয়ের উৎস:
বাঁশখালী উপজেলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক সর্ব পশ্চিমে কাথরিয়া সমুদ্র সৈকত ও গণ্ডমারা সমুদ্র সৈকত এর মাঝে তরে তরে সাজানো লবনের মাঠ। প্রতি বছরেই কাথরিয়া,সরল, গন্ডামারা উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনে জোর প্রস্তুতি চালায় চাষিরা। লবণ চাষে পশ্চিম বাঁশখালীর মানুষের আয়ের মূল মাধ্যম। তবে পূর্ব অঞ্চলের মানুষেরা এখনও কৃষি নির্ভর। এই অঞ্চলের প্রধান কৃষি ফসল ধান, আলু, শাকসবজি তাছাড়া এই অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে চা, পান, লিচু উৎপাদন হয়। খাল-বিল ও নদ-নদী অবিশ্রত হাওযায় এই অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে মৎস্য সম্পন্ন রয়েছে। এছাড়াও চিংড়ি, ইলিশ আরো অনেক সামুদ্রিক মাছ রপ্তানি করে এই অঞ্চলের মানুষ বেশ সাবলম্বী হয়ে দিনাতিপাত করছে।