‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের বছরব্যাপী প্রস্তুতি এবং করণীয়’ শীর্ষক বৈঠক অনুষ্ঠিত

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের গৃহীত মশা নিধন কার্যক্রম সঠিকভাবে মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মশার ওষুধ স্প্রে করার পরে ওই জায়গাগুলোতে ফলাফল কি হচ্ছে, তা নিয়ে ঠিকমতো কাজ করতে হবে। আমি বিভিন্ন সংস্থার বিশেষজ্ঞদের আহবান করছি আমাদের গৃহীত কার্যক্রমের মূল্যায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করুন। আমরা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিব।’

সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) সকালে রাজধানীর গুলশানের নগর ভবনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক আয়োজিত ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের বছরব্যাপী প্রস্তুতি এবং করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে ডিএনসিসি মেয়র এ কথা বলেন।

ডিএনসিসি মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই শহর আমাদের সকলের। সবাই মিলেই এই শহরের জন্য কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু মোকাবিলা করা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। মশা যখন কামড়াবে তখন কে মেয়র, কে কাউন্সিলর, কারা বিশেষজ্ঞ এসব কিছুই দেখবে না। মশা কিন্তু যখন কামড়াবে তখন সবাইকেই কামড়াবে। মশার উপদ্রব এই শহরের একটি সমস্যা। তাই আজ আমরা সবাইকে ডেকেছি। মশকনিধনে আমরা কী করছি, এগুলো ঠিক আছে কি না, আর কী কী করা যায় সেই সম্পর্কে আপনাদের জানাব। আমাদের প্রস্তুতিগুলো জানাব। সেই সঙ্গে আপনাদের কাছ থেকে পরামর্শগুলো শুনব। আর কী কী করা যায়, তার গাইডলাইন আপনারাও আমাদের জানাবেন। সব মিলিয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নেব।’

মেয়র আরও বলেন, ‘যারা মশা নিধনের সাথে জড়িত সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। আমি সহ সব কাউন্সিলরকে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করতে চাই। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টার কমতি থাকবে না। মশক নিধনের সঙ্গে যে প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের সবাইকে নিয়ে টেকনিক্যাল কমিটি করা হবে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এই কমিটি কাজ শুরু করবে।’

সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, ‘মশা নিধনে বিটিআই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়। এটা আমরা এক ঠিকাদারের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে ৫ টন এনেছিলাম। যার মূল্য ৭০ লাখ টাকা। বিটিআই যখন আনা হয়, যদিও সব পরীক্ষায় ভালো ফল পেয়েছি।সেখানে সব টেস্টে বিটিআইয়ের কোনো সমস্যা ছিল না। এর মান কোনোদিক দিয়ে কম ছিল না। ঠিকাদার কোম্পানি বিটিআই এর কান্ট্রি অব অরিজিন মিস ডিক্লারেশন করেছিল। মিস ডিক্লারেশন করে যে কোম্পানি বিটিআই এনেছে সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। সেই কোম্পানির প্রোডাক্টটি আমরা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেছি। ৭০ লাখ টাকার একটি টাকাও সেই কোম্পানিকে দেওয়া হয়নি। তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সেই কোম্পানিকে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হয়েছে। এই কোম্পানির বিরুদ্ধে যা যা ব্যবস্থা দরকার ছিল সবই নেওয়া হয়েছে। বিটিআই জালিয়াতির ঘটনায় সিটি কর্পোরেশন কোন ছাড় দেয়নি।

এসময় তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিটিআই যারা উৎপাদন করে তাদের কাছ থেকে সরাসরি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এটি আনবে। বিটিআই কোনো ঠিকাদারের মাধ্যমে আমরা আনব না। আগের বিটিআই ব্যবহার করা হবে না। আদালতের সিদ্ধান্তই ব্যবস্থা নেওয়া হবে আগের বিটিআইয়ের বিষয়। নতুন বিটিআই আনার বিষয়ে আগামী সপ্তাহে প্লান্ট প্রোটেকশন উইংয়ের সাথে সভা হবে। সভার পরে দ্রুতই বিটিআই আনা হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থা যেমন রাজউক, এয়ারর্পোট, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে তাদের নিজ নিজ জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ড্রেনে এবং ময়লায় ডেঙ্গু মশার প্রজনন আসলে কম হয়। গবেষণায় উঠে এসেছে বাসাবাড়ির স্বচ্ছ পানিতেই এডিস মশা বেশি হয়। তাই জনগণকে যার যার বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে, এ বিষয়ে সচেতন হতেই হবে। পাশাপাশি সরকার ভেকসিনের বিষয়ে কাজ করছে। আমার বিশ্বাস একটু সময় লাগলেও ভেকসিনের ব্যবস্থা হবে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘একসময় দেশে কালাজ্বর ছিল। সেটা নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। ২০২৪ সালে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাতে কাজের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য থাকার দরকার ছিল। আমাদের কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার অভাব আছে। প্রশিক্ষিত লোকের অভাব আছে, তাই এখন থেকেই কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার প্রশিক্ষণ দিয়ে কীটতত্ত্ববিদ বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে টেকনিক্যাল কমিটি করতে হবে। ওয়ার্ড ভিত্তিক ডেঙ্গু জরিপ করতে হবে। ল্যাবের সংখ্যাও বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘বিভিন্ন বেসরকারি ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের সিড এনেছে। অনুমতি পেলে অচিরেই ভ্যাকসিন তৈরি করা যাবে। এসব নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও উত্তর সিটি এক সঙ্গে কাজ করছে। সিটি কর্পোরেশনের অনেক কাজ করার পরও ডেঙ্গুর ব্যাপারে তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না কেন কারণ বের করতে হবে। শুধু সিটি কর্পোরেশনের উপরে দায় চাপিয়ে নয় বরং জনগণকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে।’

ডিএনসিসি মেয়রের উপদেষ্টা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাসার বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। মশা দুই ধরনের হয়। যখন সাধারণ মশার সঙ্গে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশাকে মেশানো হবে, ততদিন দেশ থেকে ডেঙ্গু যাবে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা করা দরকার। সিটি কর্পোরেশনকে মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ভাগ করে ফেলতে হবে। সেখানে থাকবে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ও কিউলেক্স ম্যানেজমেন্ট। ৪৩ শতাংশ ডেঙ্গুর প্রজনন হয় মাল্টিস্টেরয়েড বিল্ডিয়ের বেজমেন্টে। ২৩ শতাংশ ডেঙ্গুর প্রজনন হয় নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে।

ড. কবিরুল বাসার আরও বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণকে দুভাগে ভাগ করতে হবে। একটি হচ্ছে সিটি করপোরেশনের পার্ট, আরেকটি হচ্ছে জনগণের পার্ট। সিটি কর্পোরেশন দায় চাপায় জনগণের ওপর, আবার জনগণ দায় চাপায় সিটি কর্পোরেশনের ওপর। এ মুহূর্তে ঢাকায় ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স মশা আছে, আর ১ শতাংশ এডিস মশা আছে। এই ১ শতাংশ এডিস মশাই জনস্বাস্থ্যে সমস্যা তৈরি করে। এক শতাংশ মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় কী, এই মশা কোথায় থাকে? অর্থাৎ টার্গেট স্পেসিফিক কন্ট্রোল মেজর ফর ডেঙ্গু অ্যান্ড কিউলেক্স। কিউলেক্স মশা ও ডেঙ্গু মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলতে হবে। আর এখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজ সিটি কর্পোরেশনের।

এর আগে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী একটি প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ৬ চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন। ইমরুল কায়েস বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার ঘাটতি, নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের জ্ঞানের অভাব এবং অসহযোগিতা, পরিত্যক্ত অপরিকল্পিত ছাদবাগান, বেজমেন্ট পার্কিংয়ে জমা হওয়া পানি এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার তথ্যে অপ্রতুলতার কারণে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তাই এসব বিষয় নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম, নিপসম এর কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. গোলাম সারোয়ার, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইইডিসিআর বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মোইনুল আহসান, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম, ডিএনসিসির মশক নিধন বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান, কাউন্সিলর আব্দুল মতিন প্রমুখ।

শেয়ার করুন:

Recommended For You