লক্ষ্মীপুর জেলা জুড়ে ৭০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার

লক্ষ্মীপুরে প্রতি বছর সরকারি বরাদ্দ প্রাপ্তির পরেও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্তম্ভ শহীদ মিনার নেই জেলার ৭০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে । এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অস্থায়ীভাবে শহিদ মিনার তৈরি করে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক,শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তবে শিক্ষা কর্মকর্তা বলছেন, ইতোমধ্যে ডিজাইন অনুযায়ী কয়েকটি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার তৈরি করা হবে। 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৫টি উপজেলার ১ হাজার ১শত ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়,১৭৮টি মাধ্যমিক ও ১৩৩টি মাদরাসা রয়েছে। সবগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৭৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪০টিতে শহিদ মিনার নেই। এছাড়া ১৩৩টি মাদরাসার বেশিরভাগ স্থানে ও নেই শহিদ মিনার। এদিকে সদর, রায়পুর,রামগতি,রামগঞ্জ ও কমলনগর উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চিত্র একই। ফলে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অজানাই থাকছে শিক্ষার্থীদের। বাস্তবমুখী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় যেন দ্রুত শহীদ মিনার নির্মানের জন্য পাঁচ উপজেলার শিক্ষাকর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকদের চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দেয়া হয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার ১৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২৯টি তেই শহীদ মিনার নেই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর ফূর্তি হলেও ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে আজও শহীদ মিনার নির্মিত না হওয়ায় ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে পারছেনা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা।

উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় কলেজ, মাধ্যমিক, নিম্নমাধ্যমিক, প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডার গার্টেন ও মাদরাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪০টি। এর মধ্যে তিনটি কলেজ, ১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চারটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৩টি কিন্ডার গার্টেন, ১৪টি দাখিল-আলিম-ফাজিল মাদরাসা ও ১২টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসা রয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি কলেজ ও ১০ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়া অপর ১২৯টি প্রতিষ্ঠানে আজও শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। শহীদ মিনার না থাকায় প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে বাঁশ-কাঠ, আবার কোথাও কলাগাছ ও মাটি দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে সেখানে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। যে কারণে, মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের যথাযথ ধারণা নেওয়া ব্যাহত হচ্ছে।

রামগতি উপজেলায় অনেক উচ্চ বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নেই। প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলোতে কেন নেই শহিদ মিনার এই নিয়ে প্রশ্ন অভিভাবক ও সচেতন মহলের। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার না থাকায় অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। আবার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার থাকলেও রয়েছে অযত্ন ও অবহেলায়। দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীর নিজের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহিদ মিনার না থাকার কারণে নিজেদের উদ্যোগে পাড়া কিংবা মহল্লাতে অমর ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের উদাসীনতার কারণে শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।

মহান ভাষা আন্দোলনের ৭২বছর পেরিয়ে গেলেও লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্কুল প্রাঙ্গণে বাঁশ, কাগজ ও ককশিট দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। আর যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার আছে সেগুলোও প্রায় বছরজুড়ে অবহেলিত ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকে। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। আর যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার আছে। কতৃপক্ষের উদাসীনতায় ও সংরক্ষনের অভাবে সেগুলোও প্রায় বছরজুড়ে অবহেলিত ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে রামগঞ্জ স্টেশন মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মজুপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য আংগারপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম কাজিরখীল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামগঞ্জ রাব্বানিয়া কামিল মাদ্রাসা, রামগঞ্জ মহিলা দাখিল মাদ্রাসা, অভিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজসহ প্রায় শতাধীক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত শহীদ মিনার নির্মান করা হয়নি।

উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, এই উপজেলার মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬১টি, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫টি, মাদ্রাসার সংখ্যা ২৬টি, কলেজের সংখ্যা ৭টি সহ মোট ২২৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠন রয়েছে। অভিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুল, রহিম, আয়েশা, ইয়াছমিনসহ অন্যানারা বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারির দিন আমাদের বড় ভাইয়েরা বাঁশ, কলা গাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে। আমরা ওখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই।

রায়পুরে ৯০ শতাংশ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এরমধ্যে মাধ্যমিক, মাদরাসা, কারিগরি ও বেসরকারিসহ মোট ২৫৫ প্রতিষ্ঠানে মধ্যে শহীদ মিনার আছে ১০০ টিতে। আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১২১টির মধ্যে শহীদ মিনার আছে মাত্র ৭টিতে। ফলে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনারে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করে।

এ বিষয়ে রায়পুর – রামগঞ্জ -সদর – কমলনগর – রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা জানান, যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই, সেগুলো চিহ্নিত করে এবং যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবহেলিত অবস্থায় আছে সেগুলোর বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য উপজেলার প্রত্যকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষা অফিসগুলোকে নির্দেশ দেয়া হবে।

রায়পুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো.মইনুল হোসেন বলেন, যে সব বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নাই, পরিদর্শনে সময় নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়। শহীদ মিনার থাকলে বিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। বায়োমেট্রিক মেশিন করোনা কালীন সময়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে এই বিষয়ে কোন নির্দেশনা আসেনি এখনো। ৮টি প্রধান শিক্ষক পদ খালি রয়েছে। সহকারী শিক্ষক পদে ৭৬টি পোষ্ট খালি রয়েছে।এছাড়াও মিড ডে মিল চর আবাবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু রয়েছে। চরপাতায় স্মার্ট ভিলেজে মৌলভী সামসুল হক মেমোরিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে মিল্ক ডে চালু রয়েছে।

লক্ষ্মীপুর -২ আসনের সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেন , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকলে ছেলে-মেয়েরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সর্ম্পকে যেমন জানতো, তেমনি বাস্তবধর্মী শিক্ষা পেতো। শহীদদের প্রতি বেড়ে যেতো তাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি। প্রতি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার থাকা জরুরী।এছাড়াও বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ,মিড ডে মিল সহ প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ভিত মজবুত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিবেন জেলা উন্নয়ন সভায় ।

শেয়ার করুন:

Recommended For You