এমপি নয়ন স্যার খুবই পাতলা একটা কম্বল দিছে, বাবা কিন্তুু শরীর ঢাকমু নাকি মাথা ঢাকমু নাকি পা ঢামকু বুজিনারে বাবা। একজনের গায়ে কোনো রকমে হয়’- বললেন রফিক নামে একজন খেটে খাওয়া শ্রমিক।রায়পুর উপজেলার মধুপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি।
 সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন ২ হাজার কম্বল বিতরণ করেন। তার দেয়া উপহার কম্বলটি পেয়েছিলেন রফিক।  ‘পাতলা কম্বলে শীত যায় না। এই শীতে পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে দিন যাচ্ছে।’ আক্ষেপের সহিত বলছিলেন। সরকারিভাবে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা কম্বল নিয়ে অভিযোগ পুরো জেলায়ই। কারণ, এসব কম্বলে শীত নিবারণের মূল উপাদান উলের অস্তিত্ব নেই। আগে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের কম্বল বিতরণ হতো। এবার তা কমিয়ে দেড় কেজি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিতরণ করা হয়েছে ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের কম্বল। ফলে সরকারি কম্বল পেয়েও শীত কাটছে না শীতার্তদের।
লক্ষ্মীপুরে শীতের তীব্রতা বাড়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্টে রয়েছে ভাসমান জেলেরা (মানতা সম্প্রদায়)। ঠান্ডায় কাঁপছে পুরো সম্প্রদায়টি। শীতের কারণে রাতে তাদের ঘুমাতে কষ্ট হয়। গত ১২ দিন ধরে মাছ শিকারে যাচ্ছেন না তারা। সদর উপজেলা চররমনী মোহন ইউনিয়নের মজুচৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট এলাকায় মানতা সম্প্রদায়ের ৬ জন জেলের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে জেলা শহরেও শীতের তীব্রতা লক্ষ্য করা গেছে। প্রায় ১০ দিন আগেও রাত ১১টা পর্যন্ত বাজারে জনসাধারণের চলাচল লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু এখন রাত ৮টা বাজতেই বাজারশূন্য হয়ে পড়ে। শীত থেকে বাঁচতে সন্ধ্যার পরই অধিকাংশরাই বাসা-বাড়িতে অবস্থান নেয়। এবার লক্ষ্মীপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রিতে (সূত্র আবহাওয়া ভিত্তিক ওয়েবসাইট) নেমেছে। নদী এলাকায় গিয়েও শীতের তীব্রতা অনুভূত হয়েছে।
মানতা সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নৌকাতেই সংগ্রাম করে তাদের জীবন কাটে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তারা নৌকা থেকে অন্য কোথাও যায় না। সম্প্রদায়টির পুরুষ সদস্যরা নানান কারণে স্থানীয়-হাট বাজারে গেলেও নারীরা নৌকাতেই থাকে। একটি শিশুর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নৌকাতেই কাটে।
কথা হয় বকুল বেগম, সুখিয়া বেগম, আছমা আক্তার ও আবদুর রহিমসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন, তারা কখনও জমিতে বসবাস করেনি। জন্মের পর থেকেই তারা নৌকাতেই বসবাস করে আসছেন। ঘর-বাড়িতে বসবাস করার আনন্দও কখনও তারা পায়নি। তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবারই একই অবস্থা। বর্ষাতে বৃষ্টির সঙ্গে যুদ্ধ, গ্রীষ্মের খরতাপে রৌদ্রেও পুড়তে হয় তাদের। শীতের তীব্রতা তাদের চেয়ে অন্যদের তেমন গায়ে লাগে না। নদী থেকে ভেসে আসা বাতাস যেন বরফের মতো ঠান্ডা। এ বাতাসে পুরো শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হয়। গত বছরও অনেকই তাদের পাতলা কম্বল দিয়ে গেছে। কিন্তু এবার শীতের তীব্রতা বাড়লেও কেউই তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি।
লিজা আক্তার নামে এক ১১ বছরের শিশুর সঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায় তার নানি বকুল বেগমকে। এ সময় লিজার গায়ে কোনো শীতের পোশাক দেখা যায়নি। জানতে চাইলে লজ্জায় কথা বলতে চাচ্ছিল না লিজা। তবে তার নানি বকুল বেগম জানান, মেয়েটির বাবা চলে গেছে। এখন মায়ের আয় দিয়েই কোনরকম সংসার চলে। এরমধ্যে ১০ দিন আগে নদীতে জাল ফেলে অল্পকিছু মাছ পেয়েছে। এখন শীতের কারণে নদীতেও যাওয়া হচ্ছে না। খুব কষ্টে তাদের দিন কাটছে। নৌকাতে শীত নিবারণের যা আছে তা গায়ে জড়িয়েই রাতে ঘুমাতে হয়। স্বামী না থাকায় বকুল তার মেঝো মেয়ে নাজমার সঙ্গে এক নৌকাতেই বসবাস করেন।
সুখিয়া বেগম বলেন, নদীই তাদের জীবন-জীবিকা। নদীতে জাল ফেলতে পারলেই তাদের আয় হয়। কিন্তু শীতের কারণে নদীতে যাচ্ছে না। এতে আয় রোজগারও বন্ধ তাদের। মানতা সম্প্রদায়ের সর্দার সৌরভ মাঝির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মজুচৌধুরীরহাট এলাকায় রহমতখালী খালে (লঞ্চঘাট এলাকা) ১২০টি ভাসমান জেলে পরিবার ছিল। এরমধ্যে ৪০টি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার সরকারি ঘর দেওয়া হয়েছে। তারা এখন সরকারি ঘরে বসবাস করছে। তবে তারাও মাছ শিকার করে জীবিকানির্বাহ করে। এখন ৮০টি পরিবার ভাসমান অবস্থায় জীবন পার করছে। এরমধ্যে ৪-৫জন আশপাশ এলাকায় জমি ক্রয় করেছে। তারা কেউই এখনো সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। জমির টাকা পরিশোধের পর ঘর নির্মাণের টাকা জোগাড় পর্যন্ত ভাসমান অবস্থাতেই তাদের তাদের থাকতে হবে।
সৌরভ মাঝি বলেন, সরকারের সহযোগিতা তারা সব সময় পেয়ে আসছে। এবার শীত বেশি পড়ছে। গতবার সরকারি কম্বল ছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো শীতবস্ত্র দিয়েছে। কিন্তু এবার কেউই তাদের পাশে নেই। শীতের কারণেই জেলেরা নদীতে যাচ্ছে না।
লক্ষ্মীপুরে কয়েকদিন ধরেই শীতের তীব্রতা বেড়েছে। এ শীতের মধ্যেই খুব কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে ভাসমান জেলেদের (মানতা সম্প্রদায়)। খবর পেয়ে কম্বল নিয়ে মেঘনা নদীর পারে ছুটে যান লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান। এ শীতে প্রায় ২০০ পরিবার পেয়েছে ডিসির দেওয়া উষ্ণ উপহার। গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাট মেঘনারপাড় ধীবর বিদ্যানিকেতন প্রাঙ্গণে জেলেদের হাতে কম্বলগুলো তুলে দেন ডিসি। অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরে শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করেছেন জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ।
শনিবার (২০ জানুয়ারি) রাত পৌনে ১২ টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত মেঘনা নদীর তীরে বসবাস করা দ্ররিদ্র জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন হাট-বাজারে ছিন্নমূল মানুষ ও জেলা শহর এলাকায় অসহায় মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করেন তিনি।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার উপপরিচালক সাজিয়া পারভিন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আক্তার হোসেন শাহিন, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান, চররমনী মোহন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু ইউছুফ ছৈয়াল। জেলে সর্দার সোহরাব মাঝি বলেন, আমাদের এখানে ২২০টি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি পরিবার ডাঙায় থাকেন। এ ছাড়া ২৫টি পরিবারকে সরকার ঘর দিয়েছে। ১৮০টি পরিবার নৌকাতেই বসবাস করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবই নৌকাতেই সংঘটিত হয়।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন,আমাদের উপজেলা প্রশাসন ও চেয়ারম্যানরা কম্বল বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সময়ই তাদের খোঁজ নেওয়া হয়।