জানা যায়,গত ১৮ জানুয়ারি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু প্রীতম সানাকে নিয়ে আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা থেকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে যাচ্ছিলেন তার স্বজনরা। এসময় লাল বাহিনী তাদের গতিরোধ করে। ইজিবাইকে করে সাতক্ষীরা শহরে যাওয়া যাবেনা জানিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় শিশুটিসহ তার পরিবারের সদস্যদের। এসময় প্রীতম সানার অসুস্থতার কথা বললেও মনগলেনি লাল বাহিনীর সদস্যদের। একপর্যায়ে এই সড়ক দিয়ে যেতে হলে চাঁদা দেওয়ার কথা বলেন লাল বাহিনীর সদস্যরা৷তবে ওইসময় বাড়তি কোন অর্থ না থাকাতে চাঁদার টাকা দিতে ব্যর্থ হন পরিবারটি। উপায় না পেয়ে উল্টোপথে ২০ কিলোমিটার ঘুরে সাতক্ষীরা মেডিকেলে শিশুটিকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
জানা যায়,বিগত কয়েক বছর ধরে সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কের চাঁদপুরের সাত্তারের মোড়সহ বেশ কিছু জায়গাতে থ্রি-হুইলার গাড়ি দাঁড় করিয়ে টাকা দাবি করে কিছু লোকজন। স্থানীয়দের কাছে তারা লাল বাহিনী নামে পরিচিত। এদের কাছে লাল রঙের ছোট ছোট পতাকা থাকে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই লাল বাহিনীকে নিয়ন্ত্রন করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান।
বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নে মো.মিজানুর রহমান চৌধুরী চেয়ারম্যান হিসেবে জয়লাভ করার পর থেকে তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে লাল বাহিনী।বর্তমানে সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কে চেয়ারম্যান মিজান চৌধুরীর বাস যাতায়াত করাতে এই সড়ক দিয়ে তিন চাকার থ্রি-হুইলার(ইজিবাইক,মহেন্দ্র,
সরেজমিনে নিহত প্রীতম সানার গ্রামের বাড়িতে যেয়ে দেখা যায়,একমাত্র শিশু সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন শিশুটির পিতামাতা।শোকে ছায়া নেমে এসেছে গোটা এলাকা।প্রীতম সানার বাড়িতে শত শত মানুষের ভীড় থাকলেও তাদের কান্নার আহাজারিতে ভেঙে পড়ছেন উপস্থিতিরাও। শিশুটির মা বন্দনা সানা,বাবা বিকাশ সানা, দাদি অঞ্জলী সানা জানান, ‘ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় প্রীতম সানা।তবে অর্থ-অভাবে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি।একপর্যায়ে ওইদিন প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় অল্পকিছু টাকা নিয়ে ইজিবাইকে করে সাতক্ষীরা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম।পথিমধ্যে চাঁদপুরের সাত্তারের মোড়ে পৌঁছানো মাত্র লাল বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ঘিরে ধরে। তারা আমাদের বহনকৃত ইজিবাইক থেকে আমাদের নামিয়ে দেয়।এবং বাসে করে সাতক্ষীরা যেতে বলে।’
তারা বলেন, ‘আমরা তাদেরকে (লাল বাহিনী) প্রীতমের অসুস্থতার কথা বললেও তাদের মন গলেনি৷ বরং অকথ্য ভাষা ব্যবহার করতে থাকে আমাদের সাথে। একপর্যায়ে তারা চাঁদার টাকা দাবি করে। তবে প্রীতমের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় টাকা ছিলনা বিধায় আমরা চাঁদার টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করি।এজন্য তারা আমাদের উল্টো পথে ২০ কিলোমিটার ঘুরে সাতক্ষীরা মেডিকেলে আসতে বাধ্য করে। এসময় মেডিকেলে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রীতম সানাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।’
এসময় অশ্রুসিক্ত নয়নে তারা বলেন,’ মিনিট ত্রিশ আগে প্রীতমকে হাসপাতালে নিতে পারলে সে বেঁচে থাকতো।এমনটায় ডাক্তার আমাদেরকে বলে।আজ যদি লাল বাহিনী তাদের বাঁধা না দিতো তাহলে হয়তো প্রীতম বেঁচে থাকতো জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।আর এঘটনার সুষ্ঠু বিচার এবং আর যাতে কাউকে লাল বাহিনীর কবলে পড়ে প্রাণ হারাতে না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন’ প্রীতম সানার পরিবারের সদস্যরা।
এই সড়কে শুধু ৮ মাসের শিশু প্রীতম সানাই নয়,লাল বাহিনীর অত্যাচারের বলি হয়েছেন আরও অনেকে। আরার দাসপাড়া এলাকার স্থানীয় লীলা রানী দাস অভিযোগ করে বলেন,গতবছর তার পুত্রবধূকেও সন্তান জন্মদানের আগে তাদের বহনকারী ইজিবাইকটিকে বাঁধা দিয়েছিলো মিজান চৌধুরীর এই লাল বাহিনী।হাসপাতালে দেরিতে পৌঁছানোর পর আল্ট্রাসনোগ্রামে দেখা যায় তার দুটি সন্তানের একটি মারা গেছে। তার দাবি,’লাল বাহিনীর কবলে পড়ে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।তবে মিজান চৌধুরীর ভয়ে তার বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান সবাই।’
এই সড়কে চলাচলকারী একাধিক থ্রি-হুইলার গাড়ির চালকরা বলেন, সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কে এক আতঙ্কের নাম লাল বাহিনী।যে বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চেয়ারম্যান মিজান চৌধুরী।এই রোডে তার চলাচলকৃত বাসের ভাড়া কম হবে বিধায় গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক দিয়ে কোন থ্রি-হুইলার গাড়ি চলাচল করতে দেননা তিনি।এজন্য তিনি এই সড়কের কয়েক স্তরে লাল বাহিনীর চেকপোস্ট বসান।যে চেক পোস্টে যাত্রী নামিয়ে নেয়াসহ চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে৷
তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মিজান চৌধুরী ক্ষমতাশালী হওয়াতে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেন না।যখনই তার এসমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করা হয় তখন তিনি তার ক্ষমতা বলে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানী করেন। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে লাল বাহিনীর কবলে পড়ে আর যাতে কারও প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মতিউর রহমান সিদ্দিকী বলেন,দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে সাতক্ষীরাতে যোগদান করেছি।এজন্য লাল বাহিনী সম্পর্কে অবগত নই।এধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত।মানবিক দিক থেকে অসুস্থ মানুষের সেবায় সবার উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো।তবে এঘটনা সর্বোচ্চ আমলে নিয়ে জেলা পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।তিনি আশ্বত করেন,সাতক্ষীরা সড়কে কোন বাহিনী থাকবেনা।সড়ক ব্যবস্থাকে নিরাপদ করতে পুলিশ সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহন করবে।