ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে জালিয়াতির মাধ্যমে একই জমি দুপক্ষের কাছে বিক্রি করেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ৫ শতাধিক কাঠা জমি নিয়ে করা হয়েছে এই প্রতারণা। অভিযোগের তীর বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তার দুই ছেলের দিকে।
অভিযোগ রয়েছে, রূপগঞ্জের বিভিন্ন মৌজার মূল্যবান ৫০৩ দশমিক ২৭৪ কাঠা বা ৮ দশমিক ৩৯ একর জমি প্রথমে বিক্রি করা হয় বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে। এ তথ্য গোপন রেখে কৌশলে একই জমি দ্বিতীয় দফায় বিক্রি করা হয় একটি আবাসন কোম্পানির কাছে। এভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
জানা যায়, রফিকুল ইসলাম রফিক রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। এলাকায় সাধারণ মানুষের জমি জবরদখল, নির্যাতন, গুম-খুনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরেই রূপগঞ্জে জমি জালিয়াতির জাল বুনেছেন তিনি। একই জমি দুবার বিক্রির ঘটনায় প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ এবং জালিয়াতির অভিযোগে রফিক এবং তার দুই ছেলে কাওসার আহমেদ অপু ও মেহেদী হাসান দীপুর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করা হয়েছে। মামলার তদন্তে নেমেছে পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)।
সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীরের নির্বাচনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় থেকে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। এর আগে সরকারি আরেকটি সংস্থার কাছে জমি বিক্রির পর সেই জমি ব্যাংকের কাছে বন্ধক দিয়েছিলেন রফিক। পাশাপাশি একইভাবে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে বিক্রীত জমিও লিজ দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ভয়ংকর প্রতারণা করেছিল পিতা-পুত্রের সংঘবদ্ধ চক্রটি।
নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ এবং জালিয়াতিমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রফিকুল ইসলাম রফিক, তার ছেলে কাওসার আহমেদ অপু ও মেহেদী হাসান দীপুর বিরুদ্ধে ৬টি মামলা হয়েছে। আদালতে করা মামলাগুলোর নম্বর হলো সিআর ৭৬২/২০২৩, সিআর ৭৬৩/২০২৩, সিআর ৭৭০/২০২৩, সিআর ৭৭১/২০২৩, সিআর ৭৭৩/২০২৩ এবং সিআর ৭৭৪/২০২৩।
সিআর ৭৬২/২০২৩-এর মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, কাওসার আহমেদ অপু পশ্চিমগাঁও, ছাতিয়ান, উলাব ও পূর্বগাঁও মৌজার আরএস ১৯৯, ২১, ৪১, ২৪৮, ২৬৪, ৫৭, ৯৪, ১ ও ৩১০ নম্বর দাগের মধ্যে ১.২৩২ একর জমি বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে ২০২২ সালের ৮ মার্চ ৩৪৪৮ নম্বর সাফ-কবলা দলিল মূল্যে বিক্রি করে দেয়। এর ৩ মাস পর ২০২২ সালের ১ জুন একই জমি বিক্রি করা হয় অন্য এক আবাসন কোম্পানির কাছে। ৭৫৫৯ নম্বর সাফ-কবলা দলিলে জমিটি দ্বিতীয় দফায় বিক্রির মাধ্যমে চক্রটি হাতিয়ে নেয় ১ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা।
জানা গেছে, জমি কেনার পর ওই আবাসন কোম্পানি ভূমি উন্নয়নে প্রায় ৩ কোটি ৪০ হাজার টাকা ব্যয় করে। একপর্যায়ে জালিয়াতির বিষয়টি সামনে এলে আবাসন কোম্পানিটি তাদের ব্যয়কৃত অর্থ ফেরত চাইতে যায় রফিকের কাছে। গত ১২ ডিসেম্বর ক্ষতিপূরণ দাবি করায় আবাসন কোম্পানিটির প্রতিনিধিদের হত্যার হুমকি দেয় রফিক ও তার দুই ছেলে।
এদিকে, সিআর ৭৬৩/২০২৩-এর মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মেহেদী হাসান দীপু বরুনা, কায়েতপাড়া, কায়েমসাইর, কেরানীগঞ্জ, ছাতিয়ান, বড়ালুপাড়াগাঁও, পশ্চিমগাঁও, মাঝিনা ও হরিনাগ্রাম মৌজার আরএস ২৬৬,৩৩৫, ৫২৭, ২৩০৩, ৮৮৫, ৮৭৯, ২৫১, ৩৫৮, ১১২৭, ১৪১, ৮৮০, ৮৭৯, ১৩২০, ২০৯, ১৬২, ৫,৭, ১৬৫ ও ১৭৫ নম্বর দাগের ২.০৫০৪ একর বা ১২৩.০২৪ কাঠা জমি বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে ২০২২ সালের ৮ মার্চ ৩৪৪৫, ৩৪৪৭, ৩৪৪৮ ও ৩৪৫৫ নম্বর সাফ-কবলা দলিল মূল্যে বিক্রি করে দেন। বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে জমি বিক্রির ৩ মাস পর ২০২২ সালের ১২ জুন একটি আবাসন কোম্পানির কাছে ৮১৫০ নম্বর সাফ-কবলা দলিলে পুনরায় বিক্রি করে ১ কোটি ২৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। জমি কেনার পর ওই ভূমি উন্নয়নে প্রায় ৩ কোটি ৯০ হাজার টাকা খরচ করে আবাসন কোম্পানিটি।
৭৭০/২০২৩-এর মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, কাওসার আহমেদ অপু রূপগঞ্জের মাঝিনা মৌজার আরএস ৬৯৪, ৬৯৩, ৬৯১, ১৩৯৬, ১২২৩, ১২২৫, ১২২৬, ১২২৭, ১২৩৭, ৪৯২, ৪৯৫, ৯৫৬, ১৩২২, ৪১৯, ১৫৯৯, ১৩৫৩, ৩০৩, ৩৩০,৩৩১, ১৩৩২, ১৩৯৫, ১৫৭৪ দাগের ১.৭৪৭৭ একর বা ১০৪.৮৬২ কাঠা জমি বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে ২০২২ সালের ৮ মার্চ ৩৪৪৫ নম্বর সাফ-কবলা দলিল মূল্যে বিক্রি করে দেন। বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে জমি বিক্রির ৩ মাস পর ২০২২ সালের ১ জুন একটি অবসান কোম্পানির কাছে ৭৫৫২ নম্বর সাফ-কবলা দলিলে পুনরায় বিক্রি করে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। জমি কেনার পর ওই ভূমি উন্নয়নে প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করে আবাসন কোম্পানিটি।
একইভাবে কাওসার আহমেদ অপু তার বাবা রফিকুল ইসলামের সহযোগিতায় রূপগঞ্জের বড়ালুপাড়াগাঁও, কায়েতপাড়া ও পূর্বগাঁও মৌজার ১.০৩৫৯ একর জমি পুলিশের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে একই জমি আবাসিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে ১ কোটি ৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া কোম্পানিটি প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ভূমি উন্নয়নে খরচ করেছে।
এদিকে, গত ৩১ ডিসেম্বর কাওসার আহমেদ অপু ও রফিকুল ইসলামের নামে ৭৭৩ ও ৭৭৪ সিআর মামলা হয়েছে। মামলার নথিতেও কাওসার আহমেদ অপু ও রফিকের প্রতারণার চিত্র উঠে এসেছে। নথিতে দেখা যায়, কাওসার আহমেদ অপু বড়ালুপাড়াগাঁও, পশ্চিমগাঁও, তালাশকোট, মাঝিন, ও বরুন মৌজার ০.৭৮১৯ একর জমি ২০২২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে বিক্রি করে দেন। একই জমি জালিয়াতির মাধ্যমে আবাসন কোম্পানিটির কাছে বিক্রি করে দেন। একই জমি অবসান কোম্পানিটির কাছে বিক্রি করে ৭৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন রফিক ও তার ছেলে।
এ ছাড়া রূপগঞ্জের বসুলিয়া, কায়েমসাইর, তালাশকুট ও বরুনা মৌজার আরএস ২৭৭, ৩০০, ৩৬৮, ৭২৮, ২১৯, ৪১২,১৬৬, ৩৪৫, ২৯২, ৬৬, ৫২২, ৯৮, ৫১, ৫৪৭, ৫৬, ৩০৫ ও ৩০৭ দাগের ১.৫৪ একর জমি পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছে বিক্রি করে দেন কাওসার আহমেদ অপু। একই জমি প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আবাসন কোম্পানিটির কাছে ৭৫৪৯ নম্বর দলিলে ৮১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় পুনরায় বিক্রি করেন।