
জিয়াউল হক—
(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
১৮.
এক-দুই দিনের মধ্যেই গাঁয়ের সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে যে দবির প্রামানিক তার মেয়ে সানোয়ারাকে নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কেন মেয়েকে নিরুদ্দেশে পাঠিয়েছে তা নিয়ে শুরু হল নানা রকম আলোচনা, সমালোচনা। কিন্তু এর কোনো আসল কারণ জানা গেল না। এই কথা আজিম ও মনোয়ারার কানেও এসে পৌঁছাল। কিন্তু কিভাবে এর প্রতিকার করা উচিৎ তা তারা স্থির করতে পারল না। তাই চুপ করে থাকা আর ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে ভেবে দুঃসংবাদটি আবুলের কাছে গোপন করা ছাড়া তারা কিছুই করতে পারল না। আরও একদিন শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে আজিম তার নতুন বৌকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে এলো। তারপর শুরু হল তাদের সংসার জীবনের নতুন অধ্যায়।
বিয়ের পর থেকেই আজিম সংসারের কাজে আরও বেশি মনোযোগী হতে শুরু করল। এখন প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে পান্তা খেয়ে সে নাঙ্গল, জোয়াল, গরু নিয়ে মাঠে যায়। সারাদিন মাঠে কাজ করে বিকালবেলায় বাড়ি ফিরে এসে সে দেখতে পায় নতুন বৌ সেজেগুজে তার জন্য বসে আছে। পুকুর ঘাট থেকে গোসল করে ঘরে ঢোকার পর নতুন বৌ হাসি মুখে সামনে এসে জিজ্ঞাসা করে- সারাদিন কি আমার কথা একবারও মনে পড়েনি? আজিম বলে- সোনা বৌ, তোর মতো সুন্দরী মেয়েকে মনে না করে কি থাকা যায়? আজিমের কথা শুনে নতুন বৌ অনেক খুশি হয়ে তার বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রাখে। এই বুকে আশ্রয় পাওয়ার জন্যইতো সে কত স্বপ্ন দেখেছে। আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার মতো সুখী বুঝি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আজিমও তার শক্ত সমর্থ হাত দুটি দিয়ে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে আদরে আদরে পূর্ণ করে দেয় নতুন বৌয়ের সকল চাওয়া পাওয়াকে। দুই জোড়া মানব মানবী একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে যখন নিজেদের হৃদয়ের উষ্ণতা শুষে নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই খেলার মাঠ থেকে ঢোলের ড্রিম ড্রিম শব্দ ভেসে আসে। ঢোলের এই ড্রিম ড্রিম শব্দ সবসময়ই আজিমের বুকে যেন আগুন ধরিয়ে দিত। তখন আর সে ঘরে বসে থাকতে পারত না। ছুটে যেত লাঠি খেলার মাঠে। আজ সে সুন্দরী বৌকে জড়িয়ে ধরে আছে। বৌয়ের বুকের ভেতরে টিং টিং করে অবিরামভাবে বেজে চলেছে ভালোবাসার তানপুরা। যার মাদকতায় আজ সে আবিষ্ট হয়ে আছে। তাইতো ঢোলের ড্রিম ড্রিম শব্দ আজ তাকে স্ত্রীর বুক থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারল না। আজ আর তার ছুটে যাওয়া হল না লাঠি খেলার মাঠে। বরং তারা আরো বেশি নিবিড় হলো। রচনা করল তাদের ভালোবাসার নতুন পৃথিবী। এই প্রথম খেলার মাঠে না গিয়ে সারা সন্ধ্যা আজিম তার স্ত্রীর সাথে হাসি, ঠাট্টা, মজা করে কাটাল। শুধু তাই না, রাতের খাবারের পর বিছানায় গিয়েও তারা অনেক রাত অব্দি গল্প করে কাটিয়ে দিল। যদিও সারা জীবনের অভ্যাসকে জলাঞ্জলি দেওয়ার পর বার বার তার মনে ভেসে উঠছিল লাঠি খেলার মাঠের নানা স্মৃতি কথা।
পরের দিন মাঠে কাজ করতে গিয়ে সকল বন্ধুদের সাথে দেখা হল। তারা সবাই খেলার মাঠে না য়াওয়ার জন্য আজিমকে বৌ পাগলা বলে অভিযুক্ত করল। সে তখন শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে সাময়িকভাবে নিজেকে এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করল। আজ বিকেলে সে কী করবে? স্ত্রীর সান্নিধ্যে মধুর সময় কাটাবে, না খেলার মাঠে বন্ধুদের সাথে? অনেক চিন্তাভাবনা করে যে করেই হোক স্ত্রীকে রাজি করে একদিন তার সাথে আর একদিন খেলার মাঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখল। তাইতো মাঠ থেকে ফিরে প্রতিদিনের মতো আজও পুকুর থেকে গোসল করে ঘরে ফিরে সে দেখতে পেল আজও স্ত্রী সেজেগুজে তার জন্য অপেক্ষা করছে। আজও আজিম তাকে আদর করে বুকে টেনে নিয়ে সরাসরি কোন কিছু না বলে হাসতে হাসতে তাকে বলল, কাছে থেকে না দেখেই তুমি যে আমাকে পছন্দ করতে এর পেছনের কারণ কী ছিল বলতো লক্ষ্মী বৌ?
— আপনি যে নামকরা লাঠিয়াল ছিলেন তাই।
— তুমি কি এখনও আমার লাঠিখেলা পছন্দ কর?
— অবশ্যই করি।
— আমি যদি মাঝে মাঝে লাঠি খেলার মাঠে যাই তাহলে কি তোমার আপত্তি থাকবে?
মনোয়ারা বুঝতে পারল স্বামী তাকে বুদ্ধির খেলায় পরাজিত করেছে। তাই সে আমতা আমতা করে বলল, সারাদিন আপনি মাঠে কাজে থাকেন। সন্ধ্যার পরও যদি বাইরে থাকেন, তাহলে আমি একা কিভাবে সময় কাটাবো?
— তোমার কথারও যথেষ্ট যুক্তি আছে। তোমার মনেও যেমন আমি কোন কষ্ট দিতে চাই না, তেমনি সামাজিকভাবে খেলাকে বাদ দিতে পারছি না। যদি পালা করে একদিন তোমার সাথে আর একদিন খেলার মাঠে যাই তাহলে তোমার কি কোন আপত্তি থাকবে?
মনোয়ারা বেশ বুদ্ধিমান মেয়ে। মনে মনে কষ্ট পেলেও সে স্বামীর সামাজিক অবস্থানকে কোন মতেই ছোট করতে চায় না। তাই সে বলল, আপনি যে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছেন তাতেই আমি অনেক খুশি। এখন থেকে আপনাকে এক দিন সন্ধ্যায় লাঠি খেলার মাঠে আর একদিন আমার সাথে কাটানোর অনুমতি দিলাম। স্ত্রীর অনুমতি পাওয়ার পর সেদিন বিকালে ঢোলের ড্রিম ড্রিম শব্দ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আজিম খেলার মাঠের চলে গেল। আর স্বামী কখন ঘরে ফিরবে এই নিয়ে শুরু হল মনোয়ারার অপেক্ষার প্রহর গোনা। লাঠি খেলা শেষ করে স্বামী যখন বাড়ি ফিরে আসল তখনই তার মুখে হাসি ফুটল।
বলা চলে খুব অল্প বয়সেই আজিমের সাথে মনোয়ারার বিয়ে হয়েছিল। তখন আজিমের কতই বা বয়স। বড়জোর ২২/২৩ বছর আর মনোয়ারার ১৬। তবুও পারষ্পরিক ভালোবাসা এবং দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে দিনে দিনে তারা সংসারটিকে একটা শান্তির নীড় হিসাবে গড়ে তুলতে পেরেছিল। স্ত্রীর অনুমতি থাকা সত্তেও সংসারের প্রয়োজনে সে খেলার মাঠে যাওয়া আরও কমিয়ে দিল। আড্ডার আসরেও তাকে খুব একটা দেখা যায় না। তার আগের সেই ডানপিটে স্বভাবেরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। মা আর স্ত্রী মনোয়ারাকে নিয়েই তার দিন-রাত্রি কেটে যায়। মাঝে মাঝে বন্ধু আবুলকে সময় দিতে হয়। সানোয়ারার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকেই সে দিনে দিনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। প্রথম প্রথম সে আবুলকে বলত, তোর ভাবী চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওর বাবা মা নিমরাজি হয়েছে। আর একটু হলেই তোদের বিয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আর তাকে এইসব মিথ্যা কথা বলা বলা যায় না। কারণ এখন সবাই জেনে গেছে তার প্রেমিকা সানোয়ারাকে তার বাবা নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই কথার সূত্র ধরে তারা দু বন্ধু সানোয়ারার মামা বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে পাবনা শহরে গিয়ে সেই বাড়ির আশেপাশের মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে জেনে এসেছে যে অল্প কিছুদিন আগে এই বাড়িতে একটা মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের দিনে সেই মেয়ে নাকি অনেক উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করেছিল। এই কথা শুনার পর আবুল একেবারে পাথর হয়ে গেছে। এখন তার কাজে মন নেই, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না। অন্য কোন সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ের কথা বললেও হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বলে, যাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, তাকেই যখন পেলাম না, তাহলে আর অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে চাই না। বরং সানোয়ারার সুখস্মৃতি বুকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।
— এখন তোর বয়স কম। একা একা থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। যখন বয়স বেশি হবে তখন স্ত্রী সন্তান ছাড়া তোকে কে দেখাশুনা করবে?
— যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। আল্লাহই দেখাশুনা করবে।
এই কথা বলার পর আরতো কিছু বলার থাকে না। তবুও আজিম তার পাশে থেকে দুঃখের সাথী হতে চায়। তার মনের কষ্টের একটু ভাগ নিতে চায়। আজিমের বৌ মনোয়ারাও মাঝে মাঝে তাকে বাড়িতে ডেকে পাঠায়। সেও সঙ্গ দিয়ে তার মনের কষ্টকে একটু হলেও লাঘব করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে হতাশার বৃত্ত থেকে বের করে আনা যায় না।
আবুলের সমস্যা ছাড়া আজিমের জীবনটা দিন দিন আরও সুন্দর হয়ে উঠছিল। সংসারের কাজ, নতুন বৌয়ের সান্নিধ্য আর মাঝে মাঝে আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দিয়ে দিনগুলো তার তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
আবুল সবসময় মন খারাপ করে থাকে। কিন্তু যে দিন আওয়ামী লীগের জনসভা থাকে সেদিন তার মন ভালো হয়ে যায়। সেদিন সে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলে। সেদিন তার মনও ভাল হয়ে যায়।