
জিয়াউল হক—
(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
১৭.
একদিন পরেই সানোয়ারা তাদের বাড়ির কাজের মেয়ের হাতে চিঠি দিয়ে খবর পাঠাল, আগামীকাল দুপুরে গরু কেনার জন্য বাজান পাবনার পাশের আরিফপুর হাজির হাটে যাবে। ফিরতে বেশ রাত হবে। কাল সন্ধ্যার পর পরই আমি তোদের বাড়িতে আসব। এই খবর পেয়ে আজিমও আবুলকে আসার জন্য খবর পাঠাল। আবুল ও সানোয়ারার ভালোবাসার মধ্যে সানোয়ারার বাজান বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়তমা সানোয়ার সাথে আর কোনদিন দেখা হবে এই কথা সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। তাইতো এমন সুসংবাদ পেয়ে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল।
পরের দিন বিকালবেলা যাত্রা করলেই সন্ধ্যাবেলায় সেখানে পৌঁছে প্রিয়তমার সাথে দেখা করা যায়। কিন্তু আবুলের পক্ষে কি এতোটা সময় ধৈর্য্য ধরা সম্ভব? তাইতো সেখানে যাওয়ার জন্য সকালবেলাই সে সাজগোজ শুরু করে দেয়। এমন সময় কোথা থেকে যেন একটা রঙিন প্রজাপতি এসে তার গায়ে বসল। রঙিন প্রজাপতি নাকি বিয়ের বার্তা নিয়ে আসে। তাহলে সত্যিই কি তার বিয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে? তার মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। তাই দেরি না করে তখনই আজিমের শ্বশুর বাড়ির দিকে যাত্রা করে দুপুরের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেল।
সন্ধ্যা হতে তখনও বেশ কয়েক ঘন্টা বাকি। তাইতো শুরু হল প্রিয়তমার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। প্রতীক্ষার প্রহর যে এতোটা দুঃসহ হয় তা তার আগে জানা ছিল না। প্রতিটা মুহূর্তকে যেন মনে হচ্ছিল কত বছর, কত যুগ। এই অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে তার মনের আকাশে ভেসে ওঠে সানোয়ারার সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে কত সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না কত মান অভিমানের স্মৃতি। এই সব মধুর স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই গোধূলি বিকেল পেরিয়ে এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।
প্রতীক্ষার প্রহরও অবশেষে শেষ হল। সন্ধার পর সত্যি সত্যিই সানোয়ারা মনোয়ারাদের বাড়ি এসে হাজির হল। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর অবশেষে দুজন দুজনের মুখামুখি হল। দুজনের ভালোবাসার সম্পর্কের মাঝে সানোয়ারার বাবার রক্তচক্ষু যে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে তার চিঠির মাধ্যমে আবুল তা আগেই জেনে গেছে। এভাবে মুখোমুখি বসে আর কোনোদিন যে কথা বলতে পারবে এ কথা তারা কেউই কল্পনা করতে পারেনি। হঠাৎ দুজন এতো কাছাকাছি আসার পর তাদের কারো মুখ থেকেই কোন কথা বের হয় না। শুধু ছলছল অপলক বোবা দৃষ্টিতে দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকা। এ ভাবেই কেটে যায় অনেকটা সময়। তারপর বুকের সকল কষ্টকে লুকিয়ে রেখে আবুল সানোয়ারাকে বলল, তুমি কেমন আছ?
— আমি কেমন করে ভালো থাকি বলেন। সখিতো আজিম ভাইকে পেয়ে গেল। আর বাজান আমার স্কুল বন্ধ করে দিছে। ঘরের বাইরে বের হতে দেয় না। সখির মতো কোন কিছু করলে বাজান আমার গলা কেটে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেবে বলে সাবধান করে দেছে। বলেন, এর মধ্যে ভাল থাকি কেমনে? আমার কথা থাক। আপনি কেমন আছেন বলেন?
— আমি কেমন থাকব? আজিমের বিয়ে হওয়ার পর যখন তোমাকে পাওয়ার জন্য আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম, ঠিক তখনই তোমার চিঠি পড়ে আমার মন ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। তারপরও এই ভেবে ভালো লাগছে যে তুমিতো আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসো এবং আমাদের মিলনের জন্য যে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি আছো। বলো একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারে?
— বাজান যে আমাকে আটক করে রেখেছে এই কথা জানাতেই আমি সখির সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। এখানে এসে আপনার সাথে যে দেখা হবে এ কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তাইতো এতো কষ্টের মধ্যেও নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। জানি না আমাদের আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা? তবে আজ আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, যদি কোনোদিন আপনি আমাকে ডাক দেন তাহলে পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে নদী সাঁতরিয়ে আপনার বুকে গিয়ে আশ্রয় নেব।
আবুলও দৃঢ়তার সাথে উত্তর দেয়, প্রয়োজনে তোমাকে নিয়ে দেশান্তরী হব, তবুও তোমার এই ভালোবাসাকে বৃথা যেতে দেব না।
তারপর ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তারা জীবনের কত রঙিন ছবিই না আঁকতে শুরু করল তার কোন সীমরেখা আঁকা যাবে না। প্রতীক্ষার প্রহর যেমন দীর্ঘ হয়, মিলনের প্রহরও তেমন দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এরই মধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফিরতে হবে। বাজান হাট থেকে ফিরে আসলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাইতো চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দুজন দুজনকে বিদায় দিল। বাড়ি ফিরে সানোয়ারা দেখতে পেল বাজান হাট থেকে ফিরে এসেছে। শুধু তাই না, তাকে না পেয়ে চারিদিকে খোঁজাখুজি শুরু হয়ে গেছে। সানোয়ারার বাবা খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ। তার কোন কথার নড়চড় হয় না। মেয়েকে বাইরে থেকে আসতে দেখে সে রাগতস্বরে বলল কোথায় গিয়েছিলি? তোকে না বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলাম।
সানোয়ারা মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে বলল মনোয়ারদের বাড়ি গেছিলাম।
— মনোয়ারাদের বাড়ি? তোকে না ঐ সব খারাপ লোকদের বাড়ি যেতে নিষেধ করেছিলাম। সে কথা কি ভুলে গেছিস?
বাজানের মুখে মনোয়ারাদের খারাপ লোক বলায় সানোয়ারার বুকেও যেন সাহস ভর করে। তাই একটু নির্ভীক ভঙ্গিতে সে বলে, কেন মনোয়ারা কি অন্যায় করেছে? তুমি তাদের খারাপ লোক বলছ কেন? ওরা কি করেছে?
— তুই জানিস না সে কি করেছে?
— আমি যতটুকু জানি সে কোন অন্যায় করেনি। বরং ভালোবেসে গোহালবাড়ি চরের একজন নম্র, ভদ্র ও স্বচ্ছল ছেলেকে বিয়ে করেছে।
— চরের ছেলেরা আবার নম্র ও ভদ্র হয় নাকি?
— বাজান চরের ছেলেদের সম্বন্ধে তোমার এই পুরাতন সেকেলে ধারনা বদলে ফেল। তোমাদের সমতল এলাকার কফি মাল ও তার দলের ছেলেদের চেয়ে আজিম ভাই অনেক নম্র, ভদ্র এবং স্বচ্ছল।
—তোর ধারণা ভুল। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি চরের মানুষরা কখনও নম্র ভদ্র হতে পারে না। তারা ঠগ, বাটপার।
— সমতলের কফি মালদের নানা কুকীর্তি ও অশোভন আচরণ দেখেও বাবা তুমি এই কথা বলছ?
— হ্যাঁ বলছি।
— বাজান নিতান্তই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই তুমি এ সব কথা বলছ। তোমার কথার উত্তরে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমিও চরের একজন নম্র ,ভদ্র ও স্বচ্ছল ছেলে আবুলকে ভালোবাসি। এবং আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।
— তোর এতোবড় সাহস? আমার মুখের উপর এতো বড় কথা বলায় সাহস তুই কোথা থেকে পেলি? নিশ্চয়ই মনোয়ারা তোকে এই সাহস যুগিয়েছে।
— বাজান তুমি ঠিক বলনি। মনোয়ারা আমাকে কিছুই শিখিয়ে দেয়নি। মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন সে নিজে নিজেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
— বার বার বাবার সাথে তর্ক করছিস? নির্লজ্জের মতো বাবার কাছে নিজের ভালোবাসার কথা বলছিস। এর উপযুক্ত সাজা তোকে পেতেই হবে।
— কী করবে তুমি? গলা কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবে? দাও।
—প্রয়োজনে তাই করব। তবুও চরের কোন ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেবো না। তারপর দবির প্রামানিক স্ত্রীকে ডেকে চিৎকার করে জানিয়ে দিল, কাপড় চোপড় পড়ে মেয়েসহ এখনই প্রস্তুত হও। আজ রাতেই ওকে পাবনায় তোমার ভায়ের বাসায় রেখে আসব।
স্ত্রী ভয়ে ভয়ে বলল, এতো রাতে পাবনা যাওয়ার কোন বাস পাওয়া যাবে না। বরং কাল সকালে আমরা যাব।
— আর রাতের মধ্যে তোমার বেআদপ মেয়ে যদি কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে?
— আপনি চিন্তা করবেন না। সারা রাত আমি ওকে পাহারা দিয়ে রাখব।
স্ত্রীর কথা শুনে দবির প্রামানিক একটু শান্ত হল। রাতের মতো তাদের যাত্রা বন্ধ হলেও খুব ভোরে তারা স্বামী স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে পাবনার পথে যাত্রা করল। ইচ্ছা থাকা সত্বেও সানোয়ারা সখিকে জানাতে পারল না যে তাকে একেবারে দেশছাড়া করা হচ্ছে।