
(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
১৫.
গতরাতে দাসপাড়া গায়ের আহেদ আলী সরদারের মেয়ের সাথে গোহালবাড়ি চরের আজিমের বিয়ে হওয়ার খবর বিদ্যুতের গতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সেই খবর কফি মাল ও তাদের দলের লাঠিয়ালদের কাছে পৌঁছাতেও দেরি হল না। এতো ঘুরাঘুরি করেও তারা যে মেয়ের মন জয় করতে পারল না, অথচ চির শত্রু আজিমকে হাতেনাতে ধরার পরও সে যে এভাবে টেক্কা দিয়ে তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে তা তারা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। তাইতো তারা কোনমতেই মন থেকে এই বিয়েকে মেনে নিতে পারছিল না। বিয়ে হয়ে গেছে বলেই পথ ছেড়ে দিলে চলবে না। বরং শত্রুর যাত্রা পথে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করতে হবে। এখন তাদের বড় কাজ রজমাল চাচাকে বুঝিয়ে চরের ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার অপরাধে আহেদ আলী সরদারের বিরুদ্ধে বিচার বসায়ে তাকে হেনস্থা করার ব্যবস্থা করা। তাই তারা দল বেঁধে রজমাল চাচার বাড়ি গিয়ে হাজির হল। সেখানে পৌঁছে রজমাল মাতবরকে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে তাকে লক্ষ্য করে কফি মাল বলল, গতরাতে দাসপাড়া গায়ের আহেদ আলী সরদারের মেয়ের সাথে যে গোহালবাড়ির চরের আমাদের চির শত্রু আজিমের বিয়ে হয়ে গেছে, তা কি আপনি জানেন?
— হ্যাঁ জানি। রজমাল উত্তর দেয়।
— কিভাবে জানলেন? আহেদ আলী সরদার কি তার মেয়ের বিয়েতে আপনাকে দাওয়াত দিয়েছিল?
— না, তা দেয়নি।
— তাহলে আপনি জানলেন কেমন করে?
— সে সকালে এসে আমাকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে গেছে।
— আপনি এলাকার প্রধান। আপনাকে না জানিয়ে আহেদ আলী সরকার তার মেয়ে বিয়ে দিল। এর কোন বিচার হবে না? ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা করে দিতে হবে?
এর বিচার করতে পারলে রজমালের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হতো না। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে যে নয়শাল মাল উপস্থিত ছিল। তাই তার সে আশা পূরণ হবে না। সে কথা ওদের বুঝতে নাা দিয়ে সে বলল, যে বিয়ে হয়ে গেছে তা নিয়ে কোনো কথা বলা ঠিক হবে না।
— আপনি কি জানেন অনেক দিন ধরে আহেদ আলী সরদারের মেয়ে মনোয়ারা চরের আজিমের সাথে প্রেম করে আসছিল? আমরা ওদের দুজনকে হাতেনাতে ধরেছিলাম।
— হাতেনাতে ধরেছিলে তাতো তোমরা আমাকে জানাওনি।
মেয়ের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আহেদ আলী সরদারকে বিস্তারিত জানিয়ে আমরা তাকে সতর্ক করেছিলাম। আমাদের কথায় মূল্য দিয়ে সে মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আমাদের কথাতেই কাজ হচ্ছে ভেবে বিষয়টি আপনাকে জানানো হয়নি। এতো বড় ঘটনা ঘটার পরও যে ব্যাটা এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস পাবে তাতো আমরা ভাবতেই পারিনি।
— ভাবতে যখন পারোনি তাহলে এখন আার এ বিষয় নিয়ে কথা বলে কাজ নেই।
— মাতবর সাহেব আমাদের কাছে নতুন আর একটা খবর আছে।
— নতুন কি খবর আছে বল?
— সেটা হলো দাসপাড়া গাঁয়ের আহেদ আলী সরদারের মেয়ে মনোয়ারা ও একই গাঁয়ের দবির প্রামানিকের মেয়ে সানোয়ারা দুই সখি একই সাথে গোহালবাড়ির চরের আজিম লাঠিয়াল এবং তার বন্ধু আবুলকে ভালোবাসত। আজিমতো মনোয়ারাকে বিয়ে করেই ফেলল। আমরা যদি সাবধান না হই তাহলে যে কোনো সময় আর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
এই কথা শুনে রজমাল মাতবর দৃঢ়তার সাথে বলে, নতুন করে আর যেন কোন দুর্ঘটনা না ঘটে এখনই তার ব্যবস্থা নিতে হবে। চরের ছোটলোকদের হাত থেকে আমাদের এলাকার মানুষদের সম্মান রক্ষা করতেই হবে। তাই দেরি না করে তোমরা এখনই যাও, দবির প্রামানিককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসো।
যে কথা সেই কাজ। হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে কফি মালের লাঠিয়াল দল দাসপাড়া গ্রামে গিয়ে দবির প্রামানিককে ডেকে নিয়ে আসে। দবির প্রামানিককে দেখে রুক্ষ কণ্ঠে রজমাল বলে, আহেদ আলী সরদারের মেয়ের কীর্তিকলাপের খবর তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ?
— আমি শুনেছি মাতবর সাহেব।
— তোমার মেয়ের সাথে নাকি আহেদ আলী সরদারের মেয়ের সই পাতায়েছে?
— না মাতবর সাহেব। ওরা একসাথে একই স্কুলে একই ক্লাশে পড়ে। একসাথে আসা যাওয়া করে। তাই অনেকে বানিয়ে নানা কথা বলে।
— তুমি কি জান আহেদ আলীর মেয়ে যেমন চরের ছোট লোক আজিমকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করেছে, তোমার মেয়েও তেমনি আজিমের বন্ধু আবুলকে ভালোবাসে। তুমি জানতেও পারবে না তোমার মেয়ে একদিন তোমাকে ছেড়ে ঐ বদমাইশটার হাত ধরে পালিয়ে যাবে।
— মাতবর সাহেব, দবির প্রামানিক বেঁচে থাকতে তার মেয়ের সাথে চরের কোন ছোটলোকের বিয়ে হবে না। প্রয়োজনে মেয়ের গলা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।
— সাব্বাস দবির প্রামানিক। এটাই সমতলের সম্মানিত মানুষদের কথা। তোমার কথায় আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এখন তুমি বাড়ি যাও। শুধু মুখের কথা নয়। কাজে দেখাও সত্যি সত্যি তুমি তোমার মেয়েকে চরের কোন ছোটলোকের সাথে বিয়ে দিবে না।
— দোয়া করবেন মাতবর সাহেব। আমি যেন আমার কথা রাখতে পারি।
তারপর সে নিজের বাড়ির দিকে যাত্রা করল।
দবির প্রামানিক একটু কড়া প্রকৃতির মানুষ। সে যেমন বৌ বাচ্চাকে শাসনের মধ্যে রাখে, তেমনি চরের মানুষদের দুচোখে দেখতে পারে না। মেয়ে চরের এক ছোটলোককে ভালোবাসে শুনেই তার মেজাজ চরমে উঠে গেল। তাইতো বাড়ি এসেই সে চিৎকার করে বৌ ও মেয়েকে একত্রিত করল। তারপর মেয়ের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তুই নাকি আজকাল চরেরছোট লোকদের সাথে মেলামেশা শুরু করেছিস? তোর জন্য মাতবর সাহেবের কাছ থেকে আমাকে অনেক কথা শুনতে হল।
বাবার রক্তচক্ষু দেখে ভীত হয়ে সানোয়ারা আমতা আমতা করে বলে, বাজান এ কথা সত্য নয়। তুমি ভুল শুনেছ।
— আহেদ আলীর মেয়ের সাথে তুই যেভাবে মিশিস তাতে আমার কাছে ভুল বলে মনে হচ্ছে না। আজ থেকে তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, তুই আর মনোয়ারাদের বাড়ি যাবি না। ওদের সাথে সম্পর্ক রাখবি না। আর আমার কথার অবাধ্য হলে তোর গলা কেটে আমি নদীতে ভাসায়ে দেব। তবুও অবাধ্য মেয়েকে ঘরে রাখব না।
তারপর সে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, কাল থেকে তোমার মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। সব সময় তুমি ওর উপর নজর রাখবে। আর তোমার ভাইকে খবর দাও। যত তাড়াতাড়ি পারি আমি ওর বিয়ে দিতে চাই।