লক্ষ্মীপুরে সুপারি উৎপাদনে রেকর্ড, রফতানি হচ্ছে বিদেশেও

নারকেল-সুপারিতে ভরপুর মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর’- এই প্রবাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও রয়েছে। কারণ জেলার ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত সুপারিতে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের সম্ভাবনা রয়েছে। গাছ থেকে সুপারি পাড়া, বিক্রি ও সংরক্ষণের জন্য এই মৌসুমে জেলায় কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

হায়দরগঞ্জ বাজারের বিশিষ্ট সুপারি ব্যবসায়ী তাহসিন হাওলাদার বলেন, সুপারি উৎপাদনে দেশসেরা লক্ষ্মীপুর। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-ময়মনসিংহেও পাঠানো হয় এখানকার সুপারি। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি সুপারির মৌসুম। তবে অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের শেষ সময় পর্যন্ত সুপারি সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ করা হয়। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, রায়পুর, সদর, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সুপারি বিক্রি করতে দেখা যায় কৃষক ও গৃহস্থদের। আর সাপ্তাহিক হাটগুলো জমে ওঠে সুপারি ব্যবসায়ী ও কৃষকদের উপস্থিতিতে। গ্রামের গৃহবধূরাও সুপারি বিক্রি করতে হাটে আসে।

সুপারির বড়বাজার গুলোর মধ্যে রয়েছে রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, খাসেরহাট, মোল্লারহাট, মিতালীবাজার, আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ, রামগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ, পানপাড়া, কাঞ্চনপুর, দল্টা, সদর উপজেলার দালালবাজার, রসুলগঞ্জ, চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারি, কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট, রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডারের সবচেয়ে বড় অস্থায়ী সুপারির বাজার বসে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা লক্ষ্মীপুরে এসে সুপারি কিনে নানা প্রান্তে নিয়ে যান। সেখান থেকে আবার বিদেশেও পাঠাচ্ছেন আড়তদাররা।

সদর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চল, রায়পুর ও রামগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সুপারি উৎপাদন হয়। এখানে উৎপাদিত সুপারিগুলো ভিজিয়ে ও শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। যা সারাবছর ধরে বেচা-বিক্রি হয় বলে জানায় কৃষি বিভাগ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় সুপারির উৎপাদন ভালো হয়েছে। এবার বাজারমূল্য প্রায় দ্বিগুণ। স্থানীয় হিসাবে, প্রতি পোন বা ৮০টি সুপারি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। গত বছর ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত সুপারি জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। রপ্তানি হয় বিদেশেও।

জানা যায়, সুপারি গাছ একবার রোপণ করলে তেমন কোনো পরিচর্যা ছাড়াই টানা ৩৫ থেকে ৪০ বছর ফলন পাওয়া যায়। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় অন্য ফসলের তুলনায় বেশি আয় করা যায় সুপারিতে। সুপারি বাগানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কিংবা রোগবালাই কম থাকায় এ অঞ্চলের কৃষকরা সুপারি চাষের দিকে বেশি ঝুঁকেছেন।

সংশ্নিষ্টরা জানান, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সুপারি গাছে ফুল আসে। সুপারি পুরোপুরি ফল আসে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। মূলত কার্তিক মাস আর অগ্রহায়ণ মাসই সুপারির ভরা মৌসুম। তবে এবার সময়ের আগেই বাজারে আসে সুপারি। আশ্বিন মাসের শুরুর দিকে বাজারে সুপারি আসতে শুরু করে। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সুপারির হাটগুলো জমজমাট থাকে। চাষিরা বলছেন, বাজারে একটি চক্র রয়েছে। তারা সুপারির দাম কম দেখিয়ে নিজেরা কিনে নেয়। ফলে যে দাম পাওয়ার কথা তা পাচ্ছেন না এখানের চাষিরা।

জেলার রায়পুর উপজেলায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের শহরসহ বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে এ জেলার সুপারি।

এবারো সুপারির ফলন ভালো হয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায়। এক পণ সুপারি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। ৮০টি সুপারিতে এক পণ হিসাব ধরা হয়।

লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নের ছোট বড় মিলিয়ে বিভিন্ন বাড়ির আঙিনা ও বাগানে প্রায় ৪৮৫ হেক্টর জমিতে সুপারির বাগান আছে। এ চলতি বছরের এসব বাগানের সব গাছেই সুপারির ভালো ফলন দিয়েছে।

লক্ষ্মীপুর জেলার সুপারি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। এতে উপজেলায় ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এর বাজারমূল্য ৩০ কোটি টাকার বেশি হবে।

জানা গেছে, ফলন বেশি হওয়ায় মৌসুমের শুরুতেই বাজার সয়লাব হয়ে গেছে সুপারিতে। বাজারে সুপারির অনুপাতে ক্রেতা কম। এখনও দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারী ব্যবসায়ীরা না আসায় কম দামে বাধ্য হয়ে স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে সুপারি বিক্রি করতে হচ্ছে চাষিদের। এ বছর এক কুড়ি (৮০টি) সুপারি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, মানভেদে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছরের চেয়ে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কম।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সুপারি কিনে এই সুপারি ৬০ শতাংশ পানি ভর্তি পাত্রে ভিজিয়ে রাখে। ৪০ শতাংশ সুপারি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ ও রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।

রায়পুর পৌরসভার বাজারের সুপারি ব্যবসায়ী আবু সাইদ জুটন জানান, রায়পুর উপজেলার প্রতিটা বাজারে প্রচুর পরিমাণে বিক্রির জন্য সুপারি আসছে। এখানকার সুপারি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। এতে করে লক্ষ্মীপুর বাসীর জন্য ভালো দিক। এখানকার মানুষ বলতে পারবে, আমাদের সুপারি সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। রায়পুর উপজেলার চরাঞ্চলের তিনটি ইউপির শতকরা ৯০ ভাগ পরিবার সুপারি উৎপাদনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি হাট বাজারে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক সুপারি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে। চলতি বছর ভালো ফলন হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তহমিনা খাতুন বলেন, রায়পুরে সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। সামনে বলা যায় যে, আরও ভালো হবে। কৃষকরা যদি চায় তাহলে আরও বেশি তারা সুপারির বাম্পার করতে পারে।

জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মনির হোসেন জানান, সুপারি উৎপাদনে লাভবান হওয়ায় প্রতি বছরই এ অঞ্চলের মানুষ নতুন নতুন সুপারি বাগান তৈরিতে ঝুঁকছেন। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত জেলার সুপারির হাটগুলো জমজমাট থাকে। চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বেপারিরা সুপারি কিনছেন এখানকার হাটগুলো থেকে। এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সুপারির আকার কিছুটা ছোট হলেও ফলন হয়েছে বেশি। আবহাওয়া ভাল থাকলে এভাবে প্রায় প্রতিদিনই ১৪-১৫শ গাছ থেকে সুপারী সংগ্রহ করেন প্রত্যেক শ্রমিক। এতে প্রতিদিন আয় হয় ৭০০-৮০০ টাকা। লক্ষ্মীপুরের সুপারি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। সুপারি বেচাকেনায় বর্তমানে জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন শতাধিক হাট বসছে। জেলা সদরের দালাল বাজারে সবচেয়ে বড় হাট বসে। সপ্তাহের দু’দিন বেচাকেনা চলে এই বাজারে। এখানে প্রতি বাজারে ৫কোটি টাকার সুপারি বেচাকেনা হয়।

লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা.জাকির হোসেন বলেন, লক্ষ্মীপুরে জমিতে সুপারি আবাদ হচ্ছে। সুপারি আবাদে এ জেলার অর্থনীতিতে নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে। সুপারি চাষে বাড়তি ঝামেলা ও খরচ নেই। একবার চাষ করতে পারলে কয়েক বছর এক আবাদেই অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। আমরা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় হতে সুপারি চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। সুপারি চাষ, পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিষয়ে চাষীদের কৃষি বিভাগ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এ জেলায় সুপারি চাষ লাভজনক হওয়ায় সুপারিভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলার পরামর্শ এ কর্মকর্তা।

বেশি বেশি সুপারি গাছ রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ, কৃষক ও সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের আন্তরিক প্রচেষ্টাই উৎপাদিত সুপারি জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা

Recommended For You