
(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
১৪.
মেয়ে বিয়ে দেওয়া যে কোন বাবা মায়ের জন্যই যুগপদভাবে আনন্দ ও বেদনার অনুসর্গ বয়ে নিয়ে আসে। যোগ্য পাত্রের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে পারা যেমন আনন্দের, তেমনি জন্মের পর থেকে কত আদর, যত্ন, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা দিয়ে তিলেতিলে বড় করা মেয়েটি বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে পর হয়ে যায়। সে তখন অন্য পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। বাবা মা, পরিবার-পরিজন ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয় নতুন সংসারে। দুদিন আগে যাদের সাথে কোন সম্পর্কই ছিল না, তারাই হয়ে যায় অতি আপন, আর বাবা মা হয়ে যায় ভীন-গ্রহের বাসিন্দা। কত আনন্দ, বেদনা, কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি সামনে এসে বাবা-মাকে ব্যথাতুর করে তোলে। তারপরও সেই আদরের পুতলীকে হাসি মুখে তুলে দিতে হয় অন্যের হাতে।
শেষ রাতের দিকে কন্যা বিদায় করে দেওয়ার পর পরই ফজরের নামাজের আযান শুরু হয়ে যায়। তখন মনের সকল ব্যথা ভুলে আহেদ আলী সরদার অযু করে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে নতুন দম্পতির সুখ-শান্তির জন্য দোয়া করতে গিয়ে নিজের চোখের পানিকে ধরে রাখতে পারে না। অনেক সময় ধরে কান্নাকাটি করার পর তার মনের কষ্ট যেন একটু লাঘব হয়। তারপর রাত্রিজাগা অবসন্ন শরীরকে কোন বিশ্রাম না দিয়েই নয়শাল ভায়ের পরামর্শ মতো মেয়ের বিয়ের খবর জানানোর জন্য সে টাটিপাড়া গায়ের মোড়ল রজমালের বাড়ির দিকে যাত্রা করে।
সেখানে পৌঁছে সে দেখতে পেল সবেমাত্র মোড়ল সাহেব বৈঠকখানা ঘরে এসে বসেছেন। তখনও সেখানে কোন লোকজন আসেনি। তাকে দেখে রজমাল জিজ্ঞাসা করে, আহেদ আলী, এত সকালে কী মনে করে?
— খুব একটা জরুরি কথা বলার জন্যই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।
— বলো তোমার কী জরুরি কথা।
আহেদ আলী সরদার তখন নয়শাল মালের শেখানোমতো করে তার মেয়ের বিয়ের কথা বর্ণনা করল। সাথে সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যে নয়শাল মাল হাজির ছিল সেই কথাটি বিশেষ ভাবে তুলে ধরল।
তাকে ছাড়া মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে এ কথা শুনে রজমাল মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও নয়শাল মালের কথা শুনে সে কোন উচ্চবাচ্য না করে বলল, পরিবারের সম্মান বাঁচাতে মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভালোই করেছ। নব দম্পতির জন্য আমি দোয়া করছি।
রজমালের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে আহেদ আলী সরদার মনে মনে খুশি হল। তারপর তার কাজ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ির পথে যাত্রা করল।
অন্যদিকে বিয়ে বাড়িতে যেন শুরু হয়েছে এক এলাহি কাণ্ড। কথায় আছে না— বিয়ে-সাদির মত আনন্দ সংবাদ কোনভাবেই গোপন রাখা যায় না। গত রাতে আজিমের বিয়ের কথা নয়শাল চাচা ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানত না। কিন্তু আজ এতো সকালে গাঁয়ের ছোট বুড়ো অনেকেই তার বাড়ির সামনে ভীড় জমিয়েছে। তারা সবাই আজিমের বিয়ে নিয়ে নানামুখী আলোচনায় মত্ত। এ নিয়ে তারা নিজেদের মতো করে নানা ব্যাখ্যা প্রদান করছে। তবে সবার কথারই একই সুর। আর তা হল সমতল এলাকার লোকজনতো সহজে চরের ছেলেদের সাথে তাদের মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। আজিম লাঠিখেলা দিয়েও যেমন গোহালবাড়ির চরের মুখ উজ্জ্বল করেছে, ঠিক তেমনি সমতল এলাকার সব চেয়ে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে দেখিয়ে দিয়েছে সে কেমন বাপের ব্যাটা। এই সব নানা আলোচনার মধ্যেই আজিম সেখানে গিয়ে হাজির হলো। সেখানে যাওয়ার সাথে সাথে তারা সকলে তাকে মৌচাকের মাছির মত ঘিরে ধরল। তারপর সবাই একযোগে অভিযোগ করল বিয়ের খরচ বাঁচানোর জন্যই তুমি কাউকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করেছে।
আজিম তখন সবাইকে বুঝানোর চেষ্টার করল, আসলে তোমরা যেমন ভাবছ বিষয়টি তেমন না। তোমাদের সবারইতো জানা আছে, সমতলের লোকেরা আমাদের চরের ছেলেদের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। নয়শাল চাচার পরামর্শেই আমরা বিয়ের বিষয়টি সবার কাছে গোপন রেখেছিলাম। জানাজানি হলে শুভ কাজে নানা অবাঞ্চিত বাধা আসতে পারতো। তোমরাতো জানো, বাজান অনেক ধুমধাম করে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাজান নেইতো কী হয়েছে? আমিতো আছি। সবাইকে কথা দিচ্ছি নয়শাল চাচার সাথে আলোচনা করে গাঁয়ের সবার জন্য একবেলা খাওয়ার আয়োজন করবো।
গাঁয়ের একজন বৃদ্ধ লোক সামনে এসে বলল, তোমার বাবা মালু সরদার বড় মনের মানুষ ছিল। আমরা তোমার কাছ থেকে যেমন তেমন খাবার খাব না। বাবার সম্মানের খাতিরে তোমাকে গরু জবাই করে খাওয়াতে হবে।
— আপনাদের কথা মতোই সব কিছু হবে চাচা। তবে তার আগে নয়শাল চাচার মতামতও নিতে হবে। তিনি ছিলেন বাজানের বন্ধু। তার মতামত ছাড়া আমি কোন কিছুই করতে পারব না। আজিমের কথা শুনে সবাই ভীষণ খুশি হলো। আস্তে আস্তে ভীড় বাড়ছে দেখে সুযোগ বুঝেই সে সেখান থেকে সটকে পড়ল। সেখানে তখনও চলতে থাকল বিয়ে নিয়ে নানা বিশ্লেষণ, নানা আলোচনা।
আজিমের বিয়ের জন্য সব চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তার বন্ধু আবুল। বিয়ের বাজার সওদা করা থেকে শুরু করে কাকে কাকে সাথে নিয়ে গেলে বিষয়টি গোপন রাখা যাবে সব কিছুই সে দেখভাল করেছে । আজিম ও তার নতুন বৌকে তাদের বাড়ি রেখে নিজ বাড়িতে এসে সে সারাদিনের হিসাব কষতে বসল। সত্যি কথা বলতে কী আজ প্রতিটা কাজেই সে শতভাগ সফল হয়েছে। এই সফলতার মাঝেও একটা ব্যর্থতা তার বুকের মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করে বিধছে। আর তা হলো বন্ধুর বিয়েতে ব্যস্ত থাকায় একটিবারের জন্যও পাশের বাড়ির মেয়ে তার প্রিয়তমা সানোয়ারার কোন খোঁজই নিতে পারেনি। তার এই আচরণে সানোয়ারা নিশ্চয়ই মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। যা হয়েছে তা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। সারাদিন সারা রাত এতো ব্যস্ততায় কেটেছে যে তার শরীর আর চলছিল না। তাই সে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল। আর মুহুর্তেই সে ঢলে পড়ল গভীর ঘুমের কোলে। কিন্তু খুব বেশি সময় ঘুমাতে পারল না। সানোয়ারাকে বৌয়ের বেশে সাজিয়ে তার হাত ধরে অন্য এক ছেলে নিয়ে যাচ্ছে, এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সে ধচমচিয়ে জেগে উঠলো। ঘুম থেকে জাগার পর প্রচন্ড যন্ত্রণায় তার বুকের গভীরে মোচড় দিয়ে উঠলো। কেন সে এই দুঃস্বপ্ন দেখল? চরের ছেলেদের সাথে সমতলের লোকজন তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। কিন্তু একই গায়ে বন্ধু আজিমের বিয়ে হওয়ার পর তার সহযোগিতায় সানোয়ারার সাথে নিজের বিয়ের ব্যাপারে সে যখন শতভাগ আশাবাদি হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই কেন এই দুঃস্বপ্ন? সে এর কোন কারণ খুঁজে পেল না। বরং প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথা যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। এই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে কোনমতেই সে ঘরে বসে থাকতে পারল না। এখন সে কী করবে? অনেক ভেবে দেখল আজিমের বৌ মনোয়ারা ভাবীই পারে তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ দেখাতে। এরই মধ্যে সকাল হয়ে গেছে। তাইতো সে পাগলের মতো ছুটে গেল আজিমদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল সে এক এলাহিকাণ্ড। গাঁয়ের ছোট বড় অনেক মেয়ে মানুষ মনোয়ারা ভাবীকে ঘিরে ধরে রেখেছে। এই পরিবেশে গোপন কথাতো দূরের কথা সাধারণ কথাও বলা সম্ভব নয়। বিকেলের আগে তাকে যে নিরিবিলি পাওয়া যাবে না তাও সে ভালভাবেই বুঝতে পারল। তাইতো বুকের অসহ্য ব্যথাকে হজম করে বাড়ির বাইরে এসে সে পুরুষদের জটলায় যোগ দিল।
কিন্তু সেখানে এসেও তার শান্তি মিলল না। কারণ গত রাতে আজিমের বিয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তার বন্ধু আবুল। সেখানে যেতেই সবাই তাকে ঘিরে ধরে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলল। তখন বাধ্য হয়েই নিজের বুকের ব্যথাকে মাটিচাপা দিয়ে সে যথাসম্ভব সংক্ষেপে সবার সামনে গতরাতের ঘটনা বর্ণনা করল। এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় মানুষের আগ্রহ যেন আরও বেড়ে গেল। তাই শুরু হলো নানামুখী প্রশ্ন। এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মন, মানসিকতা বা ধৈর্য্য কোনটাই তার অবশিষ্ট ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে সে সেখান থেকে পালিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে গেল। বাড়ি ফেরার পর সেই দুঃস্বপ্ন যেন তাকে আরও গ্রাস করে ফেলল। বার বার তার মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকল সত্যিই কি তার ভালোবাসার মানুষ অন্যের হাত ধরে অন্যের ঘরে চলে যাবে? সারাটা দিন সে উদ্ভ্রান্তের মতো বাড়ির মধ্যে ঘুরাঘুরি করে কাটিয়ে দিল। এই অশান্ত মনকে শান্ত করার আশায় বিকেল না হতেই সে আবার আজিমদের বাড়ি এসে হাজির হলো। সেখানে এসে সে দেখলে পেল সকালের সেই ভীড় আর নেই। আজিম ও তার নতুন বৌ ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গল্প করছে। সব হারানোর আশঙ্কা বুকে নিয়ে বেখেয়ালে সে জোরে জোরে দরজার কড়া নাড়তে শুরু করল। আজিম দরজা খুলেই দেখতে পেল আবুল দরজার ও পাশে দাঁড়িয়ে। তার হাসিখুশি মুখটা কেন যেন এক রাশ বিষাদে ভরে আছে। তোর একি অবস্থা হয়েছে বলেই আজিম দরজা খুলে আবুলকে ভেতরে ডেকে নিল। আবুলের চেহারা দেখে মনোয়ারাও চমকে উঠলো। দুজনের প্রশ্নের মুখে আবুল একেবারে নীরব। সে যেন মুখের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। দুজনের অনেক পিড়াপিড়িতে তাদের কাছে সে সকালের দুঃস্বপ্নের কথা খুলে বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
আজিম বলল, আরে পাগল এটাতো স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখে তুই এতো ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? তুই নিজ দায়িত্বে নয়শাল চাচাকে বুঝিয়ে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিলি। আমরা দুজন মিলেও কি তোর জন্য কিছুই করতে পারব না?
— হয়তো পারবি। কিন্তু আমার মনতো বুঝ মানছে না। আচ্ছা ভাবী গতরাতে সানোয়ারাকে আপনাদের বাড়িতে দেখলাম না কেন?
— ভাই আমি মাকে বলেছিলাম সানোয়াকে ডেকে আনতে। কিন্তু বাজান কাউকে ডাকতে বারণ করেছিলেন। তাই তাকে ডাকা হয়নি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাই। সানোয়ার আমার সখি। আমি জানি সে আপনাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। সে আপনাকে নিয়ে সংসার করতে চায়। তাছাড়া আমিতো আছিই। আপনি সব দুঃচিন্তা ঝেড়ে ফেলে একটু স্বাভাবিক হোন।
— দোস্ত, মনোয়ারা ঠিক কথাই বলেছে। আমরা দুজন থাকতে তোর কোন চিন্তা করার দরকার নেই।
— ঠিক আছে দোস্ত। তোদের কথায় আমি চিন্তামুক্ত হলাম।
তারপর তিনজন মিলে হাসি গল্পে মেতে উঠলো। কিন্তু গল্পের আসর জমে ওঠার আগেই আজিমের শ্বশুর আহেদ আলী সরদার অনেক বাজার সওদা নিয়ে প্রথমবারের মত মেয়ে জামাই বাড়ি বেড়াতে এলো। তখন তাকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল।