(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
১৩.
আহেদ আলী সরদার চলে যাওয়ার সাথে সাথেই নয়শাল মাল আজিম ও আবুলকে ডেকে পাঠালেন। তারপর আজিমকে বললেন, আজ রাতেই তোমার বিয়ে। বিয়ের বাজার সওদা করতে হবে। বিয়ের খরচের জন্য বাড়িতে কি নগদ টাকা পয়সা আছে?
— চাচা বিয়ের খরচের জন্য ১০০ মন পাট বাঁধাই করে রেখেছি। পাট বিক্রি করলেই টাকা পাওয়া যাবে।
— ঠিক আছে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়ে দুই বন্ধু মিলে বিয়ের বাজার করো। পাট বিক্রি করে পরে আমার টাকা দিয়ে দিলেই হবে। আর বাবা আজিম, এতো তাড়াতাড়িতো ভালো সোনার গয়না পাওয়া যাবে না। আজ শুধু একটা নাকফুল কিনে এনো। পরে কিন্তু তোমাকে অর্ডার দিয়ে মেয়ের হাতে সোনার চুড়ি, কানের সোনার দুল এবং গলায় সোনার মালা দিতেই হবে। আরও একটা কথা। মেয়ে পক্ষ আমার শ্বশুর বাড়ির বংশ। যেমন তেমন বাজার করলে কিন্তু হবে না বাজান।
আবুল বলল, চাচা এ নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি আছি না? নাকফুল, শাড়ি, ব্লাইজ, পেটিকোট, সেন্ডেল, স্নো, পাওডার, আলতা সবকিছু এক নম্বর ছাড়া কোন কিছু কিনব না।
বাড়ি ফিরেই আহেদ আলী সরদার স্ত্রীকে ডাক দিলেন। তারপর চুপি চুপি বললেন আজ রাতেই তোমার মেয়ের বিয়ে। সব কিছুর আয়োজন শুরু করো।
— আজ রাতেই মেয়ের বিয়ে! কী বলেন আপনি। আপনার মাথা ঠিক আছেতো? আত্মীয় স্বজন, পাড়া-পরশিদের না জানিয়ে কি মেয়ের বিয়ে দিবেন?
— তোমার মেয়ের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হলে এ ভাবে রাতের আঁধারে দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। শুধু তোমার মেয়েই না, নয়শাল মাল ভাইজানও এই বিয়ের পক্ষে। ছেলেতো তার বন্ধু মালু সরদারের একমাত্র সন্তান। ছেলের পক্ষে নানা সাফাই গেয়ে তিনিই বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তোমার মেয়ের মনোভাবতো আমার আগেই জানা ছিল। তাই সোজা রাজি হয়ে গেলাম।
— রাজি হয়েছেন তো কী হয়েছে। তাই বলে কাউকে না বলে কি মেয়ের বিয়ে হবে? আর গোপনে আজ রাতেই বা বিয়ে দিতে হবে কেন?
— এই সব গ্রাম্য রাজনীতি তুমি বুঝবে না। টাটিপাড়া গাঁয়ের রজমাল মাতবর জানলে এই বিয়ে হতে দিবে না। তাইতো নয়শাল মাল ভাইজান আজ রাতেই আজিমের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে চান।
— বলেন কি? বলা নেই? কওয়া নেই? মুখে বললেই কি বিয়ে হয়?
— তোমার মেয়ে যে কান্ড ঘটায়েছে তাতে গোপনে বিয়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা নেই।
— ঠিক আছে। বলেন এখন আমাকে কী করতে হবে?
— নয়শাল ভাইজান, ছেলে, ছেলের বন্ধসহ মোট ৭/৮ জন লোক আসতে পারে। বাড়ির মুরগী জবাই করে তাদের খাবার রান্না করো। মুখ মিষ্টির জন্য পায়েশ রান্না করো। আর মেয়েকে সুন্দর করে সাজাতে হবে।
— রান্নার কাজতো আমিই করতে পারবো। কিন্তু মেয়ে সাজানোর জন্য ওর বান্ধবী সানোয়ারাকে ডেকে আনলে ভালো হয় না?
— না, নয়শাল ভাইজান সব কিছু গোপনে রাখতে বলেছেন। তার বান্ধবীকে ডাকতে গেলে জানাজানি হয়ে যেতে পারে।
— ঠিক আছে। তাহলে আগে মেয়েকেই সব কিছু জানাই। তারপর দেখি কী করা যায়।
মা মেয়েকে ডাক দিয়ে বললো, মা আজ রাতেই তোর বিয়ে। এতো কষ্ট এতো আদর যত্ন করে তোকে মানুষ করলাম, এতো তাড়াতাড়িই তুই পর হয়ে গেলি?
— কী বলো মা? আমার বিয়ে? কার সাথে? তোমরা কি কফির কথা শুনে আমাকে সাগরে ভাসায়ে দিচ্ছ?
— নারে পাগলি, তোর সেই পছন্দের ছেলের সাথেই বিয়ে।
— কি বলো মা! আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না। কিভাবে সম্ভব হলো?
— আজ সকালে গোহালবাড়ির চরের নয়শাল মাল তোর বাজানকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আজিমতো তার বন্ধুর ছেলে। তিনিই তোদের দুজনের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তোর বাজান শুধু বিয়েতে রাজি হয়েছে।
— মা তোমার কথা শুনে আমার কান্না পাচ্ছে।
— কান্না পাচ্ছে কেন?
— দুই কারণে কান্না পাচ্ছে। প্রথমে তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে বলে। দ্বিতীয় কারণ প্রিয় মানুষকে জীবন সাথি হিসাবে পাওয়ার আনন্দে। যেভাবে তোমরা আমার স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিলে, আমিতো ভেবেছিলাম একদিন আমাকে বিষ খেয়েই আত্মহত্যা করতে হবে।
— কী অলক্ষ্মুণে কথা বলিস মা!
— মা এখনতো তোমাদের এসব চিন্তা করার দরকার নেই। তোমাদের ছেড়ে যেতে কষ্ট হলেও প্রিয় মানুষকে পাওয়ার আনন্দে আমি এখন আত্মহারা। আচ্ছা মা, সানোয়ারাকে ডাকা যায় না?
— না, তোর বাজান সরাসরি মানা করে দিয়েছে। টাটিপাড়ার মাতবর রজমাল জানতে পারলে তোর বিয়ে হতে দেবে না। তাই খুব গোপনে আমরা তোর বিয়ে দিতে চাই। আমি রান্না করতে যাচ্ছি। আর তুই নিজেই যতটুকু পারিস সাজগোজ কর।
এই কথা শুনে মনোয়ারার ভীষণ কান্না পেল। কিছুতেই সে কান্না সংবরণ করতে পারলো না। মাকে জড়িয়ে ধরে সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। অনেক আদর করে মেয়ের কান্না থামায়ে মা রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আর আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্নার দোলাচলে দুলতে দুলতে মনোয়ারা নিজেই নিজের বিয়ের সাজগোজ শুরু করলো।
অন্যদিকে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বিয়ের সাজে সেজে আজিম বন্ধু আবুলকে সাথে নিয়ে মায়ের কাছে এসে তাকে সালাম করে বললো, মা আমার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করো।
— বাবা আমিতো সব সময়ই তোর জন্য দোয়া করি।
— তা করো জানি। কিন্তু আজ যে আমি বিয়ে করে তোমার বৌমাকে ঘরে আনতে যাচ্ছি। তাই আজ আমাকে একটু বেশি দোয়া করো।
— বাজান সত্যিই তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস?
— হ্যাঁ মা, সত্যি যাচ্ছি। আমার সাজগোজ দেখে বুঝতে পারছো না?
— তাতো পারছিই। তোকে না সকালে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাস বাজান? তখনতো কিছুই বললি না।
— মা তখনতো জানতাম না, আজ রাতের মধ্যে নয়শাল চাচা আমার বিয়ের সব আয়োজন করে ফেলবে।
— তোর নয়শাল চাচা বিয়ে ঠিক করেছে? তাইলেতো ভালোই। তোর বাজান বেঁচে থাকলে আজ কতই না খুশি হতো। বাবা তোর জন্য প্রাণভরে দোয়া করি। আল্লাহ যেন তোকে সুখে-শান্তিতে রাখে।
তারপর ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে বিদায় দিলেন।
সত্যি সত্যি মাঝরাতের দিকে নয়শাল মাল আজিম, আবুল, বয়জার, দিরাই, সোনাইসহ তার আরও কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে সাথে নিয়ে দাসপাড়া গায়ের আহেদ আলী সরদারের বাড়ি গিয়ে হাজির হল। আজিম যেন ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। রাতের স্বপ্নের মতো সেই রাতে সত্যি সত্যি আজিমের সাথে মনোয়ারার বিয়ে হয়ে গেল। পালকিতে চড়ে গোহাইলবাড়ির চরে ফিরতে তাদের প্রায় ভোর হয়ে গেল। তাই হলো না তাদের কোন বাসর রাত, না হলো কোন আদর-সোহাগ।
আজিমের মা নতুন বৌয়ের মুখ চিনি করায়ে অতি আদরের সাথে তাকে বাসর ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, বৌমা রাত ভোর হয়ে এসেছে। সারা রাততো একটুও ঘুমাওনি। বিছানায় শুয়ে তুমি একটু আরাম করো। তারপর দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিয়ে তিনি বাইরে চলে এলেন।
মা বের হয়ে আসার পর পরই আজিম ঘরে ঢুকে বৌকে বললো, ভোর হয়ে গেছে। এখনই পাড়ার লোকজন এসে পড়বে। তুমি একটু বিশ্রাম করো। আমি বরং ওদের সাথে কথা বলি।
— তাই বলে আজকের রাতে আমার সাথে একটু সময়ও থাকবেন না?
— সোনা বৌ! সারাজীবন তোমার সাথে থাকার জন্যইতো নয়শাল চাচাকে বলে তোমাকে বিয়ে করে এনেছি। এখন এই সকাল বেলায় তোমার পাশে থাকলে মানুষ নানাভাবে হাসিঠাট্টা করবে। আমি ওসব শুনতে পারব না। আর আজইতো শেষ রাত না? কাল সারা সারা রাত আমরা দুজন গল্প করে কাটিয়ে দেব। আমি এখন আসি বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আজিম চলে যাওয়ার পর মনোয়ারা তার রাত জাগা অলস দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিল।
ঘর থেকে বাইয়ে এসে আজিম দেখতে পেল এরই মধ্যে রাতের আঁধার কেটে গিয়ে পূর্ব আকাশ রাঙিয়ে নতুন দিনের নতুন সূর্য উদিত হতে শুরু করেছে। মনোয়ারাকে বিয়ে করার পর থেকেই আজিমের মন খুশিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষকে জীবন সাথি হিসাবে পেয়ে নতুন দিনের লাল টুকটুকে নতুন সূর্যের মতো তার মনও যেন রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তার মতো সুখি মানুষ বুঝি পৃথিবীতে আর একটাও নেই।
আজকেই এই শুভ দিনে তার বার বার বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবা থাকলে কত খুশিই না হতেন। তারপর তার মনে পড়ল বাবার বন্ধু নয়শাল চাচার কথা। তিনি না থাকলে তার পক্ষে কোনোমতেই মনোয়ারাকে বিয়ে করা সম্ভব হতো না। তাইতো নয়শাল চাচার প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে গেল।