একাত্তরের পরী : পর্ব-১২

(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)

১২.

বাড়ি থেকে বের হয়ে তারা দুজন সরাসরি নয়শাল চাচার বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হলো। চাচা সবেমাত্র বাড়ি থেকে বের হয়ে বৈঠকখানায় এসে বসেছে। তখনও কোন লোকজন আসেছি। তাদের দুজনকে দেখে নয়শাল মাল বললেন, আজিম, আবুল তোমরা বসো। আগে আজিমের সাথে আমার কিছু কথা আছে।

— বলুন চাচা।

— তুমি কি সত্যিই আহেদ আলীর মেয়েকে ভালোবাসো?

— চাচা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি আপনাকে বাবার আসনে বসিয়েছি। সেই সম্পর্কের দোহাই দিয়ে বলছি, সত্যিই আমি মনোয়ারাকে ভালোবাসি। তাকে আমি বিয়ে করতে চাই। আপনি যদি আমাদের দুজনের জন্য কিছু করেন, তাহলে চির জীবনের জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

— বিয়ে করতে চাইলেইতো হবে না। তোমার মায়ের মতামত নিতে হবে না?

— চাচা আপনি যেখানে আছেন, সেখানে মা অমত করবে না।

—   কথাটা তুমি ঠিকই বলেছো। আমি থাকলে তার কোন অমত থাববে না। এখন তাহলে আসল কথায় আসা যাক। কাল রাতে অনেক চিন্তা করে ঠিক করেছি যে আমাদের সব কিছু অতি দ্রুত এবং গোপনে করতে হবে। কারণ দাসপাড়া গাঁয়ের আহেদ আলী সরদার আমার শ্বশুরের পক্ষের আত্মীয় হলেও তাদের এলাকার মাতবর রজমাল জানতে পারলে কোনভাবেই এই বিয়ে হতে দেবে না। তোমরা ভাবছো রজমানের সাথে আমার বন্ধুর মত সম্পর্ক। তাহলে সমস্যা হবে কেন? উপরে উপরে ভাল আচরণ করতে বাধ্য হলেও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে গোহালবাড়ির চরের মানুষদের সে ভাল চায় না। তাইতো রজমালের অগোচরেই আমাদের সব কিছু করে ফেলতে হবে। এই সব কথা শুনে তোমাদের চিন্তা করার কিছু নেই। ইতোমধ্যেই আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি। তোমরা আসার আগেই আহেদ আলী সরদারকে ডেকে আনার জন্য আমি লোক পাঠায়েছি। হয়তোবা দুপুরের মধ্যেই ওরা এসে পড়বে। একটা ঘটনা যখন ঘটে গেছে, তখন কিছু সমস্যা হতেই পারে। তবুও আমার বিশ্বাস আজিমের মতো নম্র, ভদ্র ও কর্মঠ ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি আহেদ আলীকে রাজি করাতে পাবর। আগে ভালোয় ভালোয় আজিমের বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর টাটিপাড়া গাঁয়ের রজমালের সাথে বসে আজিম আর কফির মাঝের সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলা যাবে। এখন আপাতত তোমরা দুজন বাজারে গিয়ে বসো। সময় হলে আমি তোমাদের ডেকে পাঠাবো। কিন্তু বিষয়টি কারো কাছে প্রকাশ করো না।

— ঠিক আছে চাচা। আজিম উত্তর দেয়।

কফি মালের মুখে মেয়ের সম্বন্ধে নানা কথা শুনার পর থেকেই আহেদ আলী সরদার বেশ চিন্তার মধ্যে ছিল। কফি বলেছিল তার মেয়ে নাকি গোহালবাড়ির চরের আজিম নামের এক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আবার গোহালবাড়ি চরের নয়শাল মাল ডেকে পাঠিয়েছে শুনেই তার মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। তখনই মনে হলো, মেয়ের কাছ থেকে আসল ঘটনা জানার জন্য স্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিল। সে কিছু জানতে পারল কিনা সেখানে যাওয়ার আগে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। স্ত্রীকে ডেকে মেয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে জানালো মেয়ে নাকি স্বীকার করেছে সত্যিই সে গোহালবাড়ি চরের আজিম নামের এক ভদ্র ও সুবোধ ছেলেকে ভালোবাসে। সে নাকি আরও জানিয়েছে— বাজান তাকে যদি ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দেয় তাহলে তার জীবনে আর কোন কিছু চাওয়ার থাকবে না। স্ত্রীর মুখে এসব কথা শুনে আহেদ আলী সরদারের মন আরও অস্থির হয়ে উঠলো। যে মেয়েকে এতো ভালোবাসা দিয়ে নিজের আদর্শে বড় করেছিল। সেই মেয়ের জন্যই সমাজের সামনে আজ তার মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের প্রতি তার অনেক রাগ হল। কিন্তু এখন তার সাথে বোঝাপড়া করার সময় নয়। নয়শাল মাল যদি সত্যিই তার মেয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে তাহলে সে কী উত্তর দিবে এই চিন্তায়ই তার মন অস্থির হয়ে উঠলো। তখন তার স্ত্রী বললো— এতো অস্থির হওয়ার কী আছে? নয়শাল ভাইয়ের তোমার চাচাতো বোনের সাথে বিয়ে হয়েছে। সেই হিসাবে সে আমাদের কাছের আত্মীয়ও বটে। তাছাড়া সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে এলাকায় তার অনেক সুনাম আছে। স্ত্রীর কথায় সে মনে একটু সাহস পেল। তারপর আল্লাহ নাম নিয়ে সে গোহালবাড়ি চরের দিকে যাত্রা করল। একটা ভাবনাই তাকে সান্ত্বনা দিল যে নয়শাল মাল আমার বোনকে বিয়ে করেছে। নিশ্চয়ই সে এমন কিছু বলবে না যাতে তার মাথা নিচু হয়।

গোহালবাড়ি চরে পৌঁছাতে সূর্য কিছুটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল। তখনও তার চারপাশে অনেক লোক বসে আছে। আহেদ আলী সরদারকে দেখেই সে বলে উঠলো, অনেক দিন পর শ্বশুরবাড়ির বড় কুটুম এসেছে। তোমরা এখন বাড়ি যাও। পরে দেখা করো বলেই আহেদ আলী সরদারের হাত ধরে সে ভেতর বাড়ির দিকে যাত্রা করলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই গিন্নিকে জোরে জোরে ডাক দিয়ে বললো, দেখ তোমার ভাই এসেছে। আমাদের দুজনের জন্য খাবার খেতে দাও।

খাবার যেন প্রস্তুতই ছিল। সাথে সাথে বড় ঘরের বারান্দায় শতরঞ্জি পেতে খাবার পরিবেশন করা হলো। অনেক সময় ধরে আহেদ আলী সরদার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোন সুযোগই পাচ্ছিল না। খেতে বসে সে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু নয়শাল মাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আগে খাওয়া দাওয়া শেষ হোক। তারপর পান খেতে খেতে সব কথা শোনা যাবে। বেচারি আহেদ আলী বাধ্য হয়েই খাবার খেতে মনোযোগ দিল।

খাবার শেষে বাটা ভর্তি পান এলো। পান খেতে খেতে নয়শাল মাল প্রথমে শ্বশুরবাড়ির সবার খবরাখবর নিল। তারপর লজ্জিত ভঙ্গীতে বললো, নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় এখন আর ওদিকে যাওয়াই হয় না।

এই সুযোগে আহেদ আলী সরদার বলল, ভাইজান আমাকে কেন ডেকেছেন তাতো এখনও জানা হলো না?

— আরে এতো তাড়াতাছি করছো কেন? ডেকেছি যখন, তখন সবই বলব।

তারপর শুরু হলো নানা গল্প। গল্পের ছলেই নয়শাল মাল হঠাৎ করেই জিজ্ঞাসা করলো, আহেদ তুমি আমার বন্ধু মালু সরদারকে চিনতে না?

— চিনব না কেন? নতুন বিয়ে হওয়ার পর তাকে নিয়ে প্রায়ই আপনি আমাদের বাড়ি যেতেন।

— ঠিক বলেছো। তুমি কি মালুর ছেলে আজিমকে চেন? ছেলেটি কিন্তু খুবই নম্র, ভদ্র এবং কর্মঠ।

আজিমের কথা শুনে আহেদ আলী মনে মনে বেশ চমকে উঠল। কিন্তু বাইরে প্রকাশ না করে বলল, তার নাম শুনেছি। সে যে ভাল লাঠি খেলে তাও জানি। তাছাড়া তার সম্বন্ধে আমার বেশি কিছু জানা নেই। ভাইজান আপনি তার কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? কয় দিন আগে আমাদের এলাকার কফি মালতো তার সম্বন্ধে অনেক খারাপ খারাপ কথা বললো।

— কফি কেমন ছেলে? তার কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?

— ভাইজান স্বীকার করছি সে ভালো ছেলে না। কিন্তু আমিতো মেয়ের বাবা। কারো কথাই ফেলে দিতে পারি না।

— তাহলে তুমিই তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে। শোন তোমার মেয়ে মনোয়ারার সাথে অনেক দিন ধরেই আজিমের একটা ভালোবাসার সম্পর্ক চলে আসছিল। ওরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসে। বন্ধুর ছেলে বলে বলছি না, আজিমের মতো ভদ্র ছেলে এ তল্লাটে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া নিজের জমিজমা আছে। কঠোর পরিশ্রম করে সে সংসারটা বেশ গুছিয়ে এনেছে। তোমার মেয়েতো আমারও মেয়ে। আমার মনে হয় কফির কথা কানে না দিয়ে তুমি যদি আজিমের হাতে তোমার মেয়েকে তুলে দাও তাহলে আল্লাহর রহমতে ওরা দুজনই সুখে থাকবে।

সরাসরি না হলেও স্ত্রীর মাধ্যমে আহেদ আলী সরদার তার মেয়ের মনোভাব জেনে এসেছে। উপরন্ত তার আত্মীয় নয়শাল মাল যে ভাবে ছেলেটির প্রশংসা করছে তাতে সে এই বিয়েতে অমত করার কোন কারণই খুঁজে পেল না। তাই একটু ঘুরিয়ে বললো, ভাইজান আমার মেয়েতো আপনারও মেয়ে। আপনি যদি ভাল মনে করেন তাহলে আমার আপত্তি থাকবে কেন। কিন্তু আমারতো একটাই মাত্র মেয়ে। ওর মাসহ সব আত্মীয় স্বজনদের সাথে আলাপ আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিলে ভাল হয় না?

— হ্যাঁ ভালো হয়। কিন্তু তাতে একটা সমস্যাও আছে।

— কী সমস্যা ভাইজান?

— তোমাদের টাটিপাড়া গাঁয়ের মাতবর রজমাল জানতে পারলে সে কোনভাবেই এই বিয়ে হতে দিবে না।

— তাকে না জানিয়ে কিভাবে আমার মেয়ের বিয়ে দেব ভাইজান?

— তাকে না জানিয়ে কিভাবে তোমার মেয়ের বিয়ে দেবে সে বুদ্ধি আমি তোমাকে দেব। কিন্তু তার আগে তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঐ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে কিনা?

আহেদ আলীর বার বার মেয়ের কথা মনে হলো। সে মাকে বলেছে ’বাজান যদি ঐ ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেয়, তাহলে আমার জীবনে আর কোন কিছু চাওয়ার থাকবে না’। বিষয়টি মাথায় রেখেই সে বলল, ভাইজান আমিতো ছেলের ভালো-মন্দ কিছু জানি না। আপনি আমার মুরুব্বি। আপনি আমার মেয়ের অমঙ্গল চাইবেন না। আপনার কথাই আমার কথা। কিন্তু সবার কথা বাদ দিলেও মেয়ের মার মতামততো নেওয়া উচিৎ।

— মেয়ের মাকে বুঝানোর কাজটি তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।

— তাহলে ভাইজান এখন আমাকে কী করতে হবে?

— তোমাকে কিছুই করতে হবে না। আজ রাতেই আজিমকে সাথে নিয়ে আমরা তোমার বাড়ি আসবো। আজ রাতেই ওদের দুজনের বিয়ে দিতে চাই।

— এতো তাড়াতাড়ি ভাইজান?

— তাতো করতেই হবে। আগেই বলেছি রজমাল জানলে বিয়ে হতে দেবে না। তাই সব কাজ আজ রাতেই শেষ করতে হবে। কাল সকালে তুমি রজমালকে গিয়ে বলবে নিজের সম্মান বাঁচাতে গত রাতে গোহালবাড়ি চরের আজিমের সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। বিয়ের অনুষ্ঠানে সে গাঁয়ের মাতবর নয়শাল মালও উপস্থিত ছিল। সময় মতো আপনাকে জানাতে না পারার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। এখানে দেরি না করে তুমি বরং বাড়ি চলে যাও। সব প্রস্তুতি শেষ করে আমরাও আসছি। কিন্তু শুভ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি গোপন রাখবে।

— ঠিক আছে ভাইজান। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। তবে আপনারা কতজন আসবেন জানালে আমার প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হতো।

— এই ধরো আমরা ৭/৮ জনের বেশি আসবো না।

শেয়ার করুন:

Recommended For You

About the Author: জিয়াউল হক