একাত্তরের পরী : পর্ব-১১

(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)

১১.

কফি মালের দলকে পরাজিত করে শেষ বিকেলের দিকে আজিম নিজের বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করল। গোধূলি বিকেল যেমন রাতের আগমনি ঘণ্টা বেজে যায় তেমনি যেন ধীরে ধীরে ঘোর অন্ধকার চারদিকে থেকে তার মনোজগৎকে ঘিরে ধরতে থাকে। নানা চিন্তায় তার পা-দুটো যেন সামনের দিকে চলার শক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। তার সব চেয়ে বেশি চিন্তা মনোয়ারাকে নিয়ে। কফি আর তার দলবল সত্য মিথ্যা নানা কল্পিত কথার রঙ মিশিয়ে মনোয়ারার চরিত্রে নানা কালিমা লেপন করে তার বাবার মনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। যার ফলে সারা জীবনের মত মনোয়ারা তার হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। যে কথা ভাবলেই তার মাথার উপর যেন সাত আসমান ভেঙ্গে পড়ে। সত্যিই যদি সে মনোয়ারাকে হারিয়ে ফেলে তাহলে তার জীবনও রাতের আঁধারের মতো অন্ধকাবে ভরে যাবে। নিভে যাবে জীবনের সব আশার আলো।

অন্যদিকে লাঠি খেলা শুরু করার পর থেকে এমন কোন বাপের বেটার সাহস হয়নি লাঠি হাতে সামনে দাঁড়িয়ে আজিমের যাত্রাপথ রোধ করার। শুধু অবুঝ প্রেমের জন্যই কফির মতো এক ভীতু শৃগাল আজ তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস পেল— এ কথা সে মানতেই পারছে না। এই ঘটনার সাথে সাথে বুঝিবা গোহালবাড়ির চরের সম্মানও ধূলায় মিশে গেল। নয়শাল চাচা শুনলে বিষয়টি কিভাবে নেবেন এটাও তার বড় চিন্তার বিষয়। তাছাড়া আবুল ছাড়া একা একা মনোয়ারার সাথে দেখা করতে আসাও যে ঠিক হয়নি তা সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আবুল সাথে থাকলে কফির মত ভীতুর ডিম কোন মতেই দুজনের সামনে দাঁড়ানোর সাহস পেত না। এখন তার কী করা উচিৎ, না উচিৎ কোন কিছুই ঠিকমতো ভাবতে পারছে না। এই যখন তার মানসিক অবস্থা তখন একা কোন কিছু না ভেবে বরং প্রথমে বন্ধু আবুলকে সব কিছু জানানোর পর দুজন মিলে ভেবে চিন্তে যা ভালো হয় তা করা যাবে ভেবে সে আবুলের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।

আবুল আজিমের সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তার জন্য হাসতে হাসতে নিজের জীবনটাও বিলিয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া সে বেশ আবেগপ্রবন। আজিমের মুখ থেকে কফি মালের দলের কীর্তিকলাপের কথা শুনে তার মাথা গরম হয়ে গেল। তার এক কথা, চল আগে কফিকে শায়েস্তা করে আসি। তারপর অন্য কিছু ভাবা যাবে। আবুলকে পাশে পেয়ে আজিমের যে হতভম্ব ভাব ছিল তা আস্তে আস্তে কেটে যেতে থাকে। এখন সে ভালো-মন্দ চিন্তা করতে পারছে। তাইতো সে বন্ধুকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, এখন যদি আমরা কফির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে যাই তাহলে সমতল ও চরের মধ্যে বড় রকমের শত্রুতা শুরু হয়ে যাবে। যার ফলে আমাদের দুজনের প্রিয় মানুষরা হাতছাড়া হয়ে যাবে। বরং তুই নয়শাল চাচার কাছে গিয়ে বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করবি যাতে চাচা আমাকে ভুল না বুঝে বরং কফির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাছাড়া আমি যে মনোয়ারাকে ভালোবাসি এবং তাকে বিয়ে করতে চাই একথা বলে একটা কিছু করার জন্য তাকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করতে হবে। আজিমের যুক্তিপূর্ণ কথায় আবুলের মাথা ঠাণ্ডা হলো। তারপর সে নয়শাল চাচার বাড়ির দিকে এবং আজিম নিজ বাড়ির দিকে যাত্রা করল। নয়শাল চাচার সাথে কথা শেষ করে আবুল আজিমের বাড়ি গিয়ে তার সাথে দেখা করবে।

তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আঁধার বেশ কিছুটা গাড় হয়ে এসেছে। হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে নয়শাল চাচা তখনও বৈঠকখানা ঘরে জল চৌকির উপর বসে আছেন। তার পাশে বেশ কয়েকজন লোক বসে আছে। আবুল গিয়ে চাচাকে সালাম দিয়ে চৌকির উপর বসল। আবুলের মুখে গভীর চিন্তার রেখা দেখে নয়শাল মাল জিজ্ঞাসা করল, আবুল কী হয়েছে?

— তেমন কিছু না চাচা।

— কিছু একটাতো হয়েছেই। তুমি কি নিরিবিলি কথা বলতে চাও?

— জ্বি চাচা।

নয়শাল মাল তখন সকলকে বিদায় করে দিয়ে আবুলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্ঠিতে তাকাল। আবুল তখন টাটিপাড়া এলাকার কফি মালের দলের সাথে আজিমের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা আদ্যপান্ত বর্ণনা করল। তারপর বলল, চাচা আপনিতো জানেন, আজিম একজন নম্র, ভদ্র এবং সুবোধ ছেলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছাড়া সে কারো সাতে পাঁচে থাকে না। সত্যি কথা বলতে কী চাচা, যে মেয়েটিসহ কফির দল আজিমকে আটক করেছিল, তাকে সে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। তাকে নিয়ে সে ঘর বাঁধতে চায়। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে আপনাকেই পিতৃতূল্য সম্মাান করে। আপনি ছাড়া তার পক্ষে কথা বলার মত আর কেউ নেই। নিজের সন্তানের মতো ভেবে বিষয়টি যদি একটু ভেবে দেখতেন তাহলে হয়তোবা এর একটা সুরাহা হতো।

আবুলের কথা শুনে নয়শাল মাল চোখ বন্ধ করে যেন চিন্তার সাগরে ডুবে গেলেন। বেশ কিছু সময় পর চোখ খুলে আবুলকে জিজ্ঞাসা করল মেয়েটির বাড়ি কোন গাঁয়ে? ওর বাবার নাম পরিচয় কি তুমি জান?

— জ্বি চাচা জানি। সে দাসপাড়া গাঁয়ের আহেদ আলী সরদারের মেয়ে মনোয়ারা।

— আহেদ আলীর মেয়ে? সেতো আমার শ্বশুর বাড়ির কুটুম। কিন্তু জানইতো সমতলের মানুষরা চরের মানুষদের ভাল চোখে দেখে না। কাল সকালে তুমি আর আজিম আসো। আমি আরও একটু ভেবে দেখি কী করা যায়।

আবুলকে নয়শাল চাচার বাড়ি পাঠিয়ে বাড়ি ফিরে আজিম কোনমতেই নিজের মনের উত্তেজনাকে কমাতে পারছিল না। নয়শাল চাচা বিষয়টিকে কিভাবে নেন এটাই তার বড় চিন্তার বিষয়। চাচা যদি বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ না করেন, আজিমকে ভুল বোঝেন, তাহলে তার জীবনের বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। আর মনোয়ারাকে নিয়ে তার ঘর বাধার স্বপ্নও বৃথা চলে যাবে। মনের উত্তেজনাকে দমন করতে না পেয়ে সে বাড়ির সামনে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরাঘুরি করে সময় পার করতে থাকে।

অন্যদিকে সন্ধ্যার পর থেকে ছেলেকে চিন্তিত দেখে আজিমের মা বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন। দুপুরবেলা মাঠে থেকে ফিরে খাবার খেয়ে সেজেগুজে ছেলে তার বাইরে গেল। বাইর থেকে আসার পর থেকেই সে তার মুখ কালো করে বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও কোন উত্তর দিচ্ছে না। প্রতিদিন আবুল ছেলেটা আসে। দুজন গল্পগুজব করে সময় কাটায়। আজ তারও কোন দেখা নেই। নানা চিন্তায় মায়ের মন যখন দিশেহারা অবস্থা, ঠিক তখনই হঠাৎ করেই আবুল এসে ছেলের ঘরে ঢুললো। তারপর ছেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে আজিম আবুলের পানে ব্যাকুল নয়নে তাকালো। তারপর বললো, দোস্ত বল, কোন ভালো সংবাদ আছে?

— সবুর দোস্ত! সবুরে মেওয়া ফলে।

— আমি টেনশনে মরে যাচ্ছি, আর তুই মজা করছিস?

— আরে মজা হবে কেন? আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে হয়ে পড়েছি। আমাকে একটু জিড়িয়ে নিতে দে।

— আবুল তোর কিন্তু অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।

— ঠিক আছে। কোন বাড়াবাড়ি করবো না। শুধু বল যদি কোন ভাল সংবাদ দিতে পারি তাহলে আমি কী পুরস্কার পাব?

— তুই যা চাইবি, তাই পাবি। আমি বিশেষ কিছু চাই না। শুধু বল আমি যদি মনোয়ারাকে তোর ঘরে এনে দিতে পারি, তুই কি আমার জন্য সানোয়ারাকে এনে দিতে পারবি?

— দোস্ত, নয়শাল চাচার মধ্যস্থতায় মনোয়ারার সাথে আমার যদি কোন ব্যবস্থা হয়ে যায়, তাহলে কথা দিচ্ছি চাচার মাধ্যমেই আমি তোকে সানোয়ারাকে পাওয়ার ব্যাবস্থা পাকা করে দেব। এবার বল নয়শাল চাচা কী বলেছেন?

— চাচা সরাসরি কিছু বলেননি, আবার অনেক কিছু বলেছেন।

— মানে কী?

— চাচা বলেছেন, মনোয়ারার বাবা আহেদ আলী সরদার নাকি তার শ্বশুর বাড়ির কুটুম। তারপর বলেছেন, তুমিতো জানো সমতলের মানুষেরা চরের মানুষদের ভাল চোখে দেখে না। রাতে আমি আরও একটু ভেবে দেখি। কাল সকালে তুমি আর আজিম আস। দেখি আজিমের জন্য কতটুকু করা যায়।

— তাহলে অনিশ্চিয়তাতো রয়েই গেল।

— কিসের অনিশ্চয়তা? আহেদ আলী সরদার চাচার শ্বশুরবাড়ির কুটুম না? উনি চেষ্টা করলে সবকিছুই সম্ভব। আর চেষ্টা করবে বলে কথাও দিয়েছেন। তাহলে আর চিন্তা কিসের?

— ঠিকই বলেছিস। চিন্তা করে কোন লাভ নেই। বরং একটু আশার খবর যে আনতে পেরেছিস, তার জন্য তোকে ধন্যবাদ। বিকেল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে। চল আগে দুজন খাবার খাই।

তারপর ঘরের দরজা খুলে আজিম মায়ে ডেকে বলে আমাদের দুজনকে খাবার খেতে দাও। ছেলের মুখ কালো চেহারা দেখে সন্ধ্যা থেকে মায়ের বুকে যে কষ্টের পাহাড় জমা হয়েছিল, তার হাসিখুশি মুখ দেখে মুহূর্তে তা উবে গেল। তাড়াতাড়ি দুবন্ধুর জন্য খাবার খেতে দিল। খাবার খেয়ে দুবন্ধু আবার দরজা বন্ধ করে দিল। আর মা নিজের বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নিল। কিন্তু চারদিক থেকে নানা চিন্তা এসে তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরল। আজিমের বাবার কথা মনে হলো। লোকটি অনেক ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে আশা পূরণ না হতেই সেতো দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। ছেলে এখন বড় হয়েছে। দিন রাত অনেক পরিশ্রম করে সংসারটাও বেশ গুছিয়ে এনেছে। এখন একটা সুন্দরী লক্ষ্মী মেয়ে দেখে ছেলের বিয়ে দিতে পারলে তার আর এমন রাত জেগে চিন্তা করতে হবে না। তারপর সে ভাবলো সুযোগ মতো ওর বাবার বন্ধু নয়শাল ভায়ের সাথে কথা বলে একটা মেয়ে খোঁজার দায়িত্ব দিতে হবে। এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শেষ রাতের দিকে একটু বুঝি চোখ লেগে এসেছিল এরই মধ্যে ফজরের আজান শুরু হয়ে গেল। আজিমের বাবা বেঁচে থাকার সময় থেকেই ভোরের আজান দেওয়ার সাথে সাথে তাদের দুজনের ফজরের নামাজ আদায় করার অভ্যাস। তাই সে আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলো না। অযু করে নামাজ আদায় করার পর জায়নামাজে বসে ছেলের বাবার জন্য, ছেলের জন্য আল্লাহর দরবারে অনেক কান্নাকাটি করল। তারপর মনটা একটু হালকা হয়ে এলো। তখন জায়নামাজ থেকে উঠে গোয়াল ঘরে গেল গরুগুলোকে খাবার দিতে।

ছেলেরও বাবার মতো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস হয়েছে। সকালের সূর্য ওঠার অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে প্রাতকাজ সেরে পান্তা ভাত খেয়ে সে নাঙ্গল জোয়াল গরু নিয়ে মাঠে যায় হালচাষ করতে। আজ রাতে ঘুমাতে যেতে দেরি হয়েছে বলেই এখনও সে ঘুম থেকে ওঠেনি। তা না হলে প্রতিদিন এতোক্ষণ মাঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত।

গরুকে খাবার দিয়ে গোয়াল ঘর থেকে বাইরে এসেই সে দেখতে পেল আজিম ও আবুল ঘুম থেকে উঠেছে। তাদের দুজনকে দেখে মা বললো-বাবা দুজনরে খেতে দেব? মাঠে হালচাষে যাবি না?

— না মা আজ যাবো না। অন্য একটা কাজ আছে। তবে আমাদের দুজনকে খাবার খেতে দাও।

মা দুবন্ধুকে খাবার খেতে দিল। খাবার খাওয়ার পর কাপড়চোপড় পরে বাইরে যাওয়ার জন্য দুজন প্রস্তুত হলো। তাদের প্রস্তুতি দেখে মা জিজ্ঞাসা করলো, বাবা কোথায় যাবি?

—এখন বলা যাবে না মা। ফিরে এসে বলবো।

তারপর হাত ধরাধরি করে দুবন্ধু বেরিয়ে গেল।

শেয়ার করুন:

Recommended For You

About the Author: জিয়াউল হক