(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
১০.
আজিম, আবুল ও গাঁয়ের যুবক ছেলেরা খেটে খাওয়া মানুষ। তারা সারা দিন মাঠে হালচাষের কাজ করে। কাজ শেষে বিকেলে মাঠে লাঠি খেলায় মেতে ওঠে। অবসর সময়ে তারা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। ইদানীং তাদের আলোচনায় আর একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। আর তা হচ্ছে আজিম ও আবুলের প্রেম কাহিনি। সপ্তাহে একদিন তারা দুজন খেলার মাঠ আর গল্পের আসর থেকে গায়েব হয়ে যায়। তারা কোথায় যায়, কেন যায় এ কথা জানতে আর কারো বাকি থাকে না।
আগামীকাল দুজনের মনের মানুষদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার দিন। কিন্তু আবুলের প্রেমিকা সানোয়ারা পাবনায় তার মামার বাড়িতে বেড়াতে যাবে তা আগেই জানিয়ে রেখেছে। তাছাড়া তার নিজেরও একটা জরুরি কাজ আছে। তাই আবুল বলে, সানোয়ারা পাবনায় মামা বাড়িতে বেড়াতে গেছে । আমারও একটা জরুরি কাজ আছে। আগামীকাল তুইও বরং দাসপাড়া যাওয়া বাতিল কর।
— তুই না গেলেও আমার যেতেই হবে। কারণ মনোয়ারার জন্য একটা সুন্দর গলার মালা কিনে রেখেছি। ওটা না দিয়ে কি থাকা যায়?
— একা যেতে তোর অসুবিধা হবে না?
— কিসের অসুবিধা। তুইতো জানিস, আমরা লোকালয়ে যাই না। নিরিবিলি মাঠের মধ্যে দেখা করি।
— ঠিক আছে। তুই তোর কাজে যাস। আমি যাব আমার কাজে। বিকেলে আবার দেখা হবে।
কথায় আছে দশ দিন চোরের একদিন সাধুর। আজিম আর আবুল এতো সাবধানতার সাথে আসা-যাওয়া করা সত্বেও দিনে দিনে তা মানুষের দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। বাড়তে থাকে কানাঘুষা। তাছাড়া মনোয়ারা টাটিপাড়া দাসপাড়া এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। টাটি এলাকার কফি মাল, দিলাল মাল, মুন্নাফ মালসহ কত ছেলেই না তার পিছে পিছে ঘুর ঘুর করেছে। মনোয়ারা কোন দিনই তাদের পাত্তা দেয়নি। সব সময় নিজের চরিত্রের বড়াই করেছে। বড় লোকের মেয়ে বলে তারাও বেশি কিছু করতে সাহস পায়নি। সেই চরিত্রবান মেয়েই কিনা তলে তলে গোহালবাড়ি চরের চির শত্রু আজিমের সাথে প্রেমের স্কুল খুলেছে। চরের নিচু মানুষেরা হাত বাড়িয়েছে উঁচু এলাকার সম্মানিত মানুষের মেয়ের দিকে। এতো সহ্য করা যায় না।
টাটিপাড়া দাসপাড়া এলাকার লাঠিয়ালরা কোন দিন লাঠি খেলায় আজিমকে পরাজিত করতে পারেনি। এবার সুযোগ এসেছে তাকে শায়েস্তা করার। আর তা করতে হলে মাথা গরম না করে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। তাই কফি মাল, দিলাল মাল, মুন্নাফ মাল বসে গোপন পরামর্শ সভায়। সিদ্ধান্ত হয়, হাতেনাতে প্রমাণ সংগ্রহ না করে বিষয়টি মনোয়ারার বাবাকে জানানো ঠিক হবে না। তাই তারা অপেক্ষায় থাকে। কবে আজিম মনোয়ারার সাথে দেখা করতে আসবে? শুরু হয় অপেক্ষার পালা।
তাদের ভাগ্য প্রসন্ন বলেই মনে হয়। মাত্র ২ দিন পাহারা দেওয়ার পরই শিকারের সন্ধান পাওয়া যায়। তাও আবার জোড়া ছাড়া। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সাধারণত আজিম একা একা মনোয়ারার সাথে দেখা করতে আসে না। সব সময় বন্ধু আবুলকে সাথে নিয়ে আসে। কিন্তু আজ সে একা এসেছে।
পড়ন্ত বিকেলে সে সুজানগর-দাসপাড়া রাস্তার নিরিবিলি প্রান্তরে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকে প্রিয়তমা মনোয়ারার সাথে দেখা করার জন্য। অন্যদিকে সশস্ত্র শত্রু শিবির প্রস্তুত। কফি মালের নেতৃত্বে ৭/৮ জন যুবক গোপনে অপেক্ষা করছে। হাতে রামদা, কিরিচ, লাঠি। তারা লুকিয়ে আজিমের গতিবিধির উপরে নজর রাখছে। আজ তারা আজিম ও মনোয়ারাকে হাতেনাতে ধরতে চায়। আজিমের মতো পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতে প্রয়োজনে আজ তারা অস্ত্র ব্যবহার করতেও পিছপা হবে না। আজিম একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, আর একবার পথের দিকে। এর অর্থ পরিষ্কার। মনোয়ারার আসার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
ঐতো মনোয়ারা আসছে। আজিম সামনে এগিয়ে যায়। তারপর নিজ হাতে প্রিয়তমার গলায় পরিয়ে দেয় মূল্যবান মালা। এমন মূল্যবান উপহার পেয়ে মনোয়ারা ভীষণ খুশি হয়। তারপর দুজন চোখ তুলে চায় একে অন্যের দিকে। দুজনের চোখ থেকেই যেন ঝরে পড়ে শতজনমের প্রেম। বিকেলের সোনারোদে সেই প্রেমের দৃশ্য দেখলে যে কোন মানুষের মনই আপ্লুত হয়ে যাবে।
তারপর মনোয়ারা বলে, আপনাকে ছাড়া আমার একটুও ভালো লাগে না। বলেন, আর কতদিন আমাকে এভাবে একা একা থাকতে হবে? তাছাড়া বাবা আমার বিয়ের তোড়জোর শুরু করে দিয়েছে। এমন কিছু হলে আমি কিন্তু বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবো।
— প্রাণপাখি এমন কথা মুখে এনো না। আত্মহত্যা মহাপাপ। তাছাড়া তোমার কিছু হলে আমিও বাঁচবো না।
— তাহলে সত্বর কিছু একটা করেন।
— তুমিতো জান আমার বাবা মারা গেছেন। ভাবছি বাবার বন্ধু নয়শাল চাচাকে তোমার বাবার কাছে পাঠাব আমাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
— বাবা যদি রাজি না হয়?
— আরে চিন্তা করো না। নয়শাল চাচা আমাদের গাঁয়ের প্রধান। আশেপাশের সাত গাঁয়ের লোক তাকে মান্য করে। তোমার বাবা চাচার কথায় রাজি না হয়ে পারবেই না।
— তারপরও যদি না বলে?
— তাহলে আমার প্রাণপাখিকে নিয়ে দেশান্তরি হবো।
— তাহলে ওসব প্রস্তাবের দরকার নেই। তারচেয়ে চলেন আমরা দুজন দেশান্তরি হয়ে যাই।
— দেশান্তরিতো হতেই পারি। কিন্তু তুমিতো জানো এই দুনিয়ায় মা ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি যদি পালিয়ে যাই তাহলে আমার বৃদ্ধা মায়ের কী হবে ভেবেছো?
— আমি কোন কিছু শুনতে চাইনে, কোন কিছু বুঝতেও চাইনে। আমার অনুরোধ আপনি একটা কিছু করেন।
— চিন্তা করো না। আমি অবশ্যই এমন কিছু করব যাতে আমার জান পাখিকে জীবন সাথি করে ঘরে তুলতে পারি।
— আগেও এ কথা বলেছিলেন।
— আগের কথা বাদ দাও। তোমায় ছাড়া এখন যে আমারও দিন কাটছে না।
— ঠিক আছে। সত্বর একটা কিছু করেন।
আজিম আর মনেরায়ারা যখন তাদের ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করতে করতে নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ঠিক তখনই কফি মালের নেতৃত্বে ৭/৮ জন সশস্ত্র যুবক তাদের পখ আগলে দাঁড়ায়।
তারপর কফি হুংকার দিয়ে বলে, আজিম এটা কী হচ্ছে?
— কেন আমি কী করেছি?
— কী করেছিস বুঝতে পারছিস না? চর থেকে এসে তুই টাটি এলাকার মেয়ের সাথে লীলাখেলা শুরু করেছিস।
— করেছি, বেশ করেছি। পারলে তুই বাধা দে।
— আমাদের গাঁয়ের সম্মানের কথা চিন্তা করে অবশ্যই তোকে বাধা দেব। আর শুধু বাধাই না। তোকে আমাদের সাথে গাঁয়ে যেতে হবে। সেখানে তোর বিচার বসাবো। বিচারে যে শান্তি হয় তাই তোকে মাথা পেতে নিতে হবে।
— এটা কি মায়ের হাতের মোয়া যে তুই বললেই সুড় সুড় করে আমি তোদের গাঁয়ে গিয়ে হাজির হবো।
— আপোষে না গেলে তোকে জোর করে নিয়ে যাবো।
— জোর করে নিয়ে যাবি আমাকে? তোদের সে মুরোধ আছে? একবার চেষ্টা করে দেখ না?
আজিম এ কথা বলার সাথে সাথে কফির ইঙ্গিতে সকল সশস্ত্র লাঠিয়াল নিরস্ত্র আজিমকে ঘিরে ধরলো।
আজিম মনোয়ারাকে বললো, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। চিন্তা করো না। অচিরেই তোমার সাথে দেখা হবে।
— আমাদের গাঁয়ের মেয়ে নিয়ে তোর ফষ্টিনষ্টি করার স্বাধ আজই মিটিয়ে দেব।
কফির কথা শুনে অজিমের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। তারপর দেখা গেল নিরস্ত্র আজিমের একহাতে লাঠি অন্য হাতে কিরিচ। তার লাঠির প্যাঁচে অল্প সময়ের মধ্যে সকল লাঠিয়াল ধরাশায়ি হলো। তখন মনোয়ারার দিকে হাত নেড়ে সে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলো। অন্যদিকে পরাজিত সৈনিকের মতো কফি তার দলবল নিয়ে মুর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো। আজিম বেশ কিছুদূর চলে যাওয়ার পর তাদের সম্বিত ফিরে এলো।
তখন তারা মনোয়ারাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো। তারপর কফি বললো, চরের ছোট লোকের ছেলেদের সাথে সম্পর্ক করতে তোর লজ্জা করে না?
— ৭/৮ জন মিলে ১ জনের কাছে পরাজিত হলি, তাতে তোদের লজ্জা করছে না?
— অন্যায় করেও বড় বড় কথা। ঠিক আছে চল। আহেদ চাচার কাছে আজ তোর সব কীর্তির কথা খুলে বলবো।
বাবার কথা শুনে মনোয়ারা মনে মনে ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু বাইরে ওদের বুঝতে না দিয়েই জোর গলায় বললো, তোদের যা ইচ্ছা তাই বল। তাতে আমার কিছু এসে যায় না।
ঠিক আছে দেখি, চাচা তোর কী বিচার করে?
— বাবা যা করবে তা তার মেয়ের ভালোর জন্যই করবে। ঝাঁঝ মিশানো কণ্ঠে মনোয়ারা উত্তর দেয়। তারপর চিন্তিত মন নিয়ে সে বাড়ি ফিরে এলো।
একদিকে আজিমের চিন্তা অন্যদিকে বাবা কী বলেন এই চিন্তায় তার মন উতলা হয়ে উঠলো। ওদিকে কফি মাল তার দল নিয়ে প্রথমে মনোয়ারা বাবা আহেদ আলী সরদারের কাছে এসে সত্য মিথ্যা মিশিয়ে তার মেয়ের সম্বন্ধে একগাদা অভিযোগ জানালো। শুধু তাই না, মেয়ের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বিষয়টি টাটিপাড়া গাঁয়ের প্রধান রজ মালকে জানানো হবে বলে তারা হুমকি দিয়ে গেল।
আহেদ আলী সরদার ভদ্র স্বভাবের মানুষ। কারো সাতে পাঁচে থাকেন না। তাছাড়া কফিকে সে ভালো ছেলে বলে মনে করে না। সেই কফির মুখে নিজের মেয়ের সম্বন্ধে বাজে কথা শুনে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। যে মেয়েকে নিজের আদর্শে গড়ে তুলেছে, যাকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, যার উপর আছে তার অগাধ বিশ্বাস। একজন অতি সাধারণ ছেলে কফির কথায় তাকে কোন শান্তি দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু নিজের সম্মানের কথা ভেবে একেবারে নির্লিপ্ত থাকাও ঠিক হবে না। তাই স্বামী-স্ত্রী দুজন অনেক আলোচনা করে তারা চারটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। প্রথমত, কফির কথামতো মেয়েকে কিছু বলা ঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত, আপাতত মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, মায়ের মাধ্যমে অতি সাবধানে মেয়ের কাছ থেকে আসল ঘটনা জানার চেষ্টা করতে হবে এবং চতুর্থত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।