একাত্তরের পরী : পর্ব-৮

(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)

৮.
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আজিম যেন কেমন হয়ে গেছে। সব সময় উদাস নয়নে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। বন্ধু আবুল ও বাবার বন্ধু নয়শাল মালের তত্ত্বাবধানে সাত দিনের দিন বাবার ফাতেহাখানি করা হয়েছে। পাশের বাড়ির বৌ এসে রান্না করে দিয়ে গেলেও মা বেটার মুখে যেন একেবারেই খাবার রোচে না। মাঝে সাঝে আবুল এসে জোর করে মা বেটাকে দুমুঠো খাবার খাইয়ে যায়। সে আজিমকে অনেক বুঝায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে মাঠে হালচাষ করতে যায় না, এমন কী যত্নের অভাবে হালের বলদ দুটিরও হয়েছে করুণ দশা। আগে বিকেল বেলা লাঠিখেলার মাঠ থেকে ঢাকের বাড়ি পড়তেই সে আর ঘরে বসে থাকতে পারত না। ছুটে যেত খেলার মাঠে। আর এখন ঢাকের ড্রিম ড্রিম শব্দ যেন তার কানেই ঢোকে না। লাঠি খেলার মাঠে না গিয়ে বরং পড়ন্ত বিকেলে ভাবুক মানুষের মতো পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে আবিরে রাঙা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে আর বলে কখন যে কার জীবনের সূর্য অন্ত যাবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।

এইভাবে চলতে থাকলে সংসারটা একেবারে রসাতলে চলে যাবে। আবুল থাকতে বন্ধুুর এমন সর্বনাশ হতে দিতে পারে না। তার জন্য কিছু একটা করতেই হবে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে গাঁয়ের প্রধান নয়শাল মালের সাথে দেখা করে সব কিছু খুলে বলে। নয়শাল মাল বলেন, আমি নানা ঝামেলায় থাকি। প্রায় ২০ দিন হতে চললো। এখনও আজিম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেন?

— চাচা আমি ভেবেছিলাম, বাবা মারা যাওয়ার পর দুই-এক দিনতো মন খারাপ থাকবেই। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন ওর পরিবর্তনের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। তাইতো বাধ্য হয়ে আপনাকে জানাতে এলাম।

— আমাকে জানায়ে ভালো করেছো। আসলে হয়েছে কী জানো, ওদের বংশে বাবা ছাড়াতো আর কোন বড় মানুষ নেই যাকে ও বাবার মতো ভাবতে পারে। ওর মতো ভালো আর উদ্দোমী ছেলেকে জাগিতে তুলতেই হবে। তুমি চিন্তা করো না। আগামীকাল সকালে আমি ওদের বাড়ি যাবো। বাবার মতো আমি ওর পাশে দাঁড়াবো।

— চাচা আপনি যদি ওদের বাড়ি গিয়ে একটু সান্ত্বনা দেন, পাশে থাকার আশ্বাস দেন, তাহলে নিশ্চয়ই সকল শোক ভুলে সে আবার আগের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। ওকে ছাড়া আমাদের লাঠি খেলার আসরও কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

— ঠিক আছে। আজিমের বিষয়টি তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। আর বন্ধু হিসাবে তুমি পাশে থাকো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আবুলের কাছ থেকে সব কথা শুনার পর দিন সকাল বেলা নয়শাল মাল সত্যি সত্যিই আজিমদের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। আজিম তখন দাওয়ায় বিছানো পাটিতে বসে যেন চিন্তার সাগরে হারিয়ে গিয়েছিল। নয়শাল মালের উপস্থিতিও তার ধ্যান ভঙ্গ হল না। তিনি গলা খাকানি দিতেই আজিম চমকে ফিরে তাকালো। সামনে নয়শাল মালকে দেখে সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম জানালো।
নয়শাল মাল স্বস্নেহে বলেন, বাবা তুমি কেমন আছো?

— ইনশাল্লাহ ভালো আছি। চাচা আপনার শরীর কেমন?

— কেমন আর থাকবো বলো? আমি আর তোমার বাবা ছিলাম সমবয়সী। তোমার বাবা চলে গেল। আমার শরীরেও নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে। তা বাবা তোমাকে তো অনেক দিন দেখি না। আবুল বললো তুমি নাকি ঘর থেকে বাইরে যাও না? খেলার মাঠেও যাও না?

— চাচা, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই কেন যেন মনকে শান্ত করতে পারছি না।

— বাবা মারা গেলেতো মন খারাপ হবেই। তার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করো। আর বাবা নেইতো কী হয়েছে? আমি তোমার বাবার বন্ধু। তুমি আমার ছেলের মতো। আজ থেকে তুমি আমাকে তোমার বাবা বলে জেনো।

নয়শাল মালের এই কথা শুনে আজিম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। চাচার বুকে মাথা লুকিয়ে সে হুহু করে কেঁদে উঠল। নয়শাল মালও কিছু না বলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখল। বেশ কিছু সময় কান্নাকাটি করার পর তার বুকের গভীরে জমে থাকা দুঃখের পাথরটা অনেক হাল্টা হয়ে গেল।

চোখ মুছতে মুছতে সে বললো চাচা আপনি বসেন। আপনি আমাকে ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেছেন। আজ আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে। মনের সকল দুঃখ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার স্নেহধন্য হয়ে আজ থেকে আমি আবার আগের মতো সংসার দেখাশুনা, হালচাষ ও লেখাধুলায় ব্যস্ত হয়ে উঠবো।

— সেটাই ভাল। তোমার বাবা নেই। মা দুঃখের সাগরে ডুবে আছে। তার পাশে দাঁড়াতে হবে না? সংসারের হাল ধরতে হবে না?

— জি চাচা। এখন থেকে আমি আবার আমার পুরাতন জীবনে ফিরে যাবো। শুধু একটাই চাওয়া আপনার স্নেহধন্য হয়ে যেন সামনের দিনগুলো পার করতে পারি।

— আমিও কথা দিচ্ছি যতদিন বেঁচে থাকবো, ততোদিন তোমায় পুত্র স্নেহে আগলে রাখবো।

আজিম নয়শাল মালের কথা শুনে চোখ মুছতে মুছতে তার পায়ের ধূলা নিয়ে মাথায় লাগালো। আর নয়শাল মাল আজিমের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে দিলেন।

সেদিন থেকে আজিমের নতুন জীবন শুরু হল। নয়শাল মাল যে তাকে পুত্র স্নেহে গ্রহণ করেছেন, তা আর গোপন থাকল না। এই খবর গোহালবাড়ি চরের প্রতিটা মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। যারা কথাটি বিশ্বাস করতে পারল না, দুজনের কথাবার্তা চালচলন দেখে তাদেরও মুখ বন্ধ হয়ে গেল। নয়শাল মালের একটু শরীর খারাপ হলে আজিম যেমন ছুটে যায়, তেমনি আজিম কোন বিপদে পড়লে নয়শাল মাল পাশে গিয়ে দাঁড়ান। আর এভাবেই আজিমের ছন্নছাড়া জীবনে ছন্দ ফিরে এলো। মায়ের সেবাযত্ন, হালচাষ, খেলাধূলা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, সব কিছুই আগের মতো চলতে থাকল।

আজিমের এই অন্ধকার দিনে আবুল যেভাবে পাশে থেকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে তাকে আলোর পথে ফিরিয়ে এনেছে সে কথা সে কোনদিনই ভুলতে পারে না। একদিন কথায় কথায় সে বন্ধু আবুলকে বলে, তুই যেভাবে পাশে থেকে আমাকে সুস্থ করে তুলেছিস গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও তোর এই ঋণ শোধ হবে না।

— মানুষের বিপদের দিনে পাশে থাকাইতো মানবতা। আর তুইতো আমার বন্ধু। তোর পাশে থাকব না? দেখবি আমি যদি কোন দিন বিপদে পড়ি তুইও ঘরে বসে থাকতে পারবি না।

— আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন তোকে কোন বিপদ না দেন। আর যদি বিপদ আসেই তাহলে আমি যেন তোর এই ঋণ কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করতে পারি।

— আমরা দুজন শুধু দুজনের বিপদে না, সবার বিপদে যেন পাশে থাকতে পারি।

— তুই ঠিকই বলেছিস বন্ধু। আজ আমরা দুজন হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, মানুষের বিপদ-আপদে পাশে থাকার পাশাপাশি যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিকার করার চেষ্টা করে যাব।

শেয়ার করুন:

Recommended For You

About the Author: জিয়াউল হক