একাত্তরের পরী : পর্ব-৭

(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)

৭.

আজ সন্ধ্যা থেকেই আজিমের মন খুব খারাপ হয়ে আছে। বার বার তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে গোহালবাড়ি গ্রাম নদীগর্ভে বিলিন হওয়ার পর তারা কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিল। তখন সংসার চালনোর প্রয়োজনে তার বাবা নদীর তীরে অস্থায়ী নিবাস তৈরি করে মনোহারি জিনিসপত্র ফেরি করে দুপয়সা উপার্জন করে দুঃখ-কষ্টে কোন মতে সংসার চালাতে শুরু করেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম ও সংসারের নানা চিন্তায় দিন দিন তার শরীর দুর্বল হতে থাকে। অন্যদিকে পড়াশুনা করতে ভালো না লাগায় আগে থেকেই সে বাবার সাথে হালচাষের কাজ শুরু করে দিয়েছিল। নদী ভাঙনের পর বাবার মতো সেও গ্রামে গ্রামে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রির কাজ শুরু করে। ফলে দুজনের উপার্জনের টাকায় সংসারের অভাব কিছুটা লাঘব হয়।

গোহালবাড়ি চরের পত্তনের পর মালু সরদার মনোহারি জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রি করার কাজ বাদ দিয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে নিজেই নতুন করে জেগে ওঠা চরে তার জমিতে হালচাষ শুরু করেন। ততদিনে আজিমও বেশ শক্ত-সমর্থ হয়ে উঠেছে। সেও ফেরি করে মালপত্র বিক্রির কাজ বাদ দিয়ে দিনে বাবাকে কৃষিকাজে সাহায্য এবং বিকেল হতেই নেমে পড়তো তার প্রিয় লাঠি খেলার মাঠে। লাঠিখেলা যেন তার জান-প্রাণ। লাঠিখেলা ছাড়া তার যেন একটা দিনও চলে না। ইতোমধ্যে সে গোহালবাড়ি চরের নয়শাল মালের দলের এক নম্বর লাঠিয়াল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। চরের মানুষদের মাঝে মাঝেই জমিজমা নিয়ে নানা রকম ঝুটঝামেলায় পড়তে হয়। তাছাড়া চোর ডাকাতের উৎপাত তো লেগেই থাকে। গাঁয়ের মানুষদের এই সব বিপদ থেকে রক্ষার করতে নয়শাল মাল নিজের পৃষ্ঠপোষকতায় এই লাঠিখেলার দলটি গড়ে তুলেছিলেন। বন্ধু মালুর ছেলে আজিম এত ভালো লাঠি খেলে বলে তারও যেন গর্বে বুক ভরে যায়।

গোহালবাড়ি চরের পত্তনের ৩/৪ বছর পার হতে না হতেই আজিমের বাবা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন তার পক্ষে হালচাষের কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে তার কোন সমস্যায়ই পড়তে হয়নি। কারণ আগে থেকেই আজিম বাবাকে হালচাষের কাজে সাহায্য করত। বাবার অসুস্থতায় সে পুরাপুরি হালচাষে আত্মনিয়োগ করে। এখন প্রতিদিন ভোর বেলায় সে নাঙল, জোয়াল, গরু নিয়ে মাঠে যায় জমি চাষ করতে। অসুস্থ বাবা ছেলের জন্য মাঠে খাবার নিয়ে যান।

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার পর বাড়ি ফিরে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করতে না করতেই বিকেল হয়ে যায়। এরই মধ্যে লাঠিখেলার দলের ঢোল, ডগর বেজে ওঠে। আজিম তখন আর নিজেকে ঘরে ধরে রাখতে পারে না। ছুটে যায় খেলার মাঠে। খেলাধুলা শেষ করে বাড়ি ফিরতে তার প্রতিদিনই বেশ রাত হয়ে যায়। বাড়ি এসে দেখে বাবা না খেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবাকে সে অনেক বলেছে, খেলা শেষে নয়শাল চাচা ডেকে নিয়ে গল্প করেন। তিনি আজিমকে অনেক স্নেহও করেন। তাইতো বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিলেই পার। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রতিদিনই ছেলের জন্য অপেক্ষা করে দেরি করে বাপ বেটা একসাথে খাবার খায়। খাওয়া শেষে সংসারের নানা টুকিটাকি বিষয় নিয়ে আলাপও হয়। বাবা বলেন, আমার শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কয়দিন আর বাঁচবো জানি না। নয়শাল চাচা তোকে পছন্দ করে শুনে আমার ভালো লাগছে। আমি না থাকলে তোর নয়শাল চাচার কথা মতো চলিস।

আজিম বলে, বাবা তুমি এসব কথা বলে আমার মন খারাপ করে দাও কেন? দেখো তোমার কিছুই হবে না। তুমি আবার পুরাপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে। নানা গল্পে রাত বেশ গভীর হয়ে যায়। তারপর যে যার মতো ঘুমাতে চলে যায়।

ঘুমাতে যাওয়ার জন্য অবশ্য আজিমেরই তাড়া থাকে বেশি। কারণ খুব ভোরে তাকে আবার হালচাষ করতে মাঠে যেতে হয়। আজিমের মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা তাকে এতো বেশি ভালোবাসে কেন? সত্যিই যদি বাবা তাদের ছেড়ে চলে যায়, তাহলে কে রাত জেগে তার জন্য অপেক্ষা করবে? কে ভালোবাসা দিয়ে বুকে আগলে রাখবে?

দিনে দিনে আজিমের বাবা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন আর বাবা তার জন্য খাবার নিয়ে মাঠে যেতে পারে না। তার কোন ভাই বোনও নেই। তাই মাকেই খাবার নিয়ে মাঠে যেতে হয়। মাকে খাবার নিয়ে মাঠে আসতে দেখে দুঃখ কষ্টে আজিমের দুচোখ বেয়ে আশ্রুধারা ঝরে পড়ে। মনে হয় তার কি একটা ভাই খাকতে পারতো না? কিংবা একটা বোন। তাহলে মাকে খাবার নিয়ে মাঠে আসতে হতো না। মানুষের কষ্টের সময় যেন সহজে পার হতে চায় না। আজিমের ১ দিন যেন ১ বছরের সমান। লাঠিখেলা আছে বলে তবুও তার দিন কেটে যায়।

দিনে দিনে তার বাবা আরও দুর্বল হয়ে পড়েন। তার রোগক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকালে আজিমের বুকের ভেতরে নীরব কান্না শুরু হয়ে যায়। বাবার চিন্তায় সব সময় তার মন বিষন্ন হয়ে থাকে। গোহালবাড়ির চরে কোন ডাক্তার নেই। মানুষের অসুখে-বিসুখে এখানে তাই একমাত্র কবিরাজই সবার ভরসা। কিন্তু কবিরাজের চিকিৎসায় বাবার কোন উন্নতি হচ্ছে না। আবার তার শারীরিক অবস্থাও এতো ভালো না যে, তাকে নিয়ে নদী পার করে টাটিপাড়া গাঁয়ের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। এ যেন বাবার মৃত্যুর জন্য নীরব অপেক্ষা। এই অপেক্ষার শেষ কোথায়?

এমন রোগে শোকে ভুগে ভুগে সত্যিই একদিন আজিমের বাবা পরপারে পাড়ি জমালেন। সে তখন মাঠে হালচাষ করছিল। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে লাঙল জোয়াল ফেলে পাগলের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি হাজির হলো। বাবার নীরব নিথর মুখটা দেখে সে যেন পাথর হয়ে গেল। মুখে কোন কথা নেই, দুচোখে পানি নেই, শুধু বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা। বাল্য বন্ধু আবুল পাশে থেকে তাকে অনেক সান্ত্বনা দিল। কিন্তু কোন কিছুতেই তার ধ্যান ভঙ্গ হলো না। বন্ধুর মৃত্যুর খবর পেয়ে গাঁয়ের প্রধান নয়শাল মাল ছুটে এলেন। আজিমের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে বুকে টেনে নিয়ে সান্তনা দিলেন। তারপর বন্ধুর দাফন কাফনের জন্য গোর খোড়া, টাটিপাড়া থেকে কাফনের কাপড়, বাঁশ জোগাড় করা, মওলানা সাহেবকে খবর দেওয়াসহ সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন।

মালু সরদারকে দাফন করার পর নয়শাল মাল আজিমকে তার বাড়িতে রেখে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, দুঃখ করে কী করবে বাবা? তোমাকে আমাকে সবাইকেতো একদিন অন্ধকার কবরে যেতে হবে। তোমার বাবা আমার বন্ধু ছিল। বাবা নেইতো কী হয়েছে? আমাকে তোমার বাবা মনে করো। কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলেতে লজ্জা কোরো না। তারপর একে একে সবাই চলে গেল। কিন্তু বন্ধু আবুল তখনও তার পাশে নীরবে বসে রইল। বাবা ছাড়া বাড়িতে আজিম আর তার মা কেমন করে থাকবে?

পাশের বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে গেছে। যেমন খাবার তেমনি পড়ে আছে। অনেক চেষ্টা করেও আবুল মা ছেলের মুখে এক লোকমা খাবারও তুলে দিতে পারল না। আজ তাদের পেটের ক্ষুধা যেন দুঃখের সাগরে ভেসে গেছে।

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সেই অমোঘ নিয়ম মেনেই দিন পার হয়ে রাতের আঁধার এসে সারা ধরণীকে ঢেকে দিল। এর চেয়েও গাঢ় অন্ধকার যেন আজিমের জীবনকে ঘিরে ধরেছে। সে ভাবতেই পারছে না তার বাবা চির দিনের মতো চলে গেছে। আর কোন দিন কেউ রাত্রি জেগে তার জন্য অপেক্ষা করবে না।

মাঝ রাতের দিকে আবুলকে বিদায় দিয়ে সে বিছানায় আশ্রয় নিল। কিন্তু সারাটা রাত ছটঠট করে কাটানোর পরও দুচোখের কোনে ক্ষণেকের জন্যও ঘুম এলো না। আস্তে আস্তে ভোর হয়ে আসছে। পাখির কিচিরমিচির ডাকে চারিদিক মুখর হয়ে উঠছে। অন্য দিনে এ সময়ে আজিমের লাঙল, জোয়াল, গরু নিয়ে মাঠে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। আজ যেন কোন তাড়া নেই। বাবা যেন তাকে অনন্ত বিশ্রাম দিয়ে গেছে। অন্ধকারে ভরে গেছে তার ঝলমলে আলোকিত জীবন।

শেয়ার করুন:

Recommended For You

About the Author: জিয়াউল হক