(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
৬.
যতই দিন যেতে থাকে ততই যেন আজিম আর আবুলের ভালোবাসার সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। এখন সপ্তাহে এক দিন দেখা করে আজিমের প্রেয়সী মনোয়ারার যেন মন ভরতে চায় না। তার আব্দার সপ্তাহে অন্তত দুই দিন দেখা করতে হবে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে কাজের অযুহাতে আজিম তার প্রস্তাব এড়িয়ে যায়। আজ আজিম আর আবুল একই সাথে তাদের প্রিয়াদের জন্য উপহার নিয়ে এসেছে— হাতের চুড়ি, কানের দুল, গলার মালা। সাথে স্নো, পাওডার আলতাতো আছেই। এই সব উপহার পেয়ে মনোয়ারা খুশিতে আজিমের প্রশস্ত বুকে আশ্রয় নিয়ে বলে, আপনি আমাকে এতো ভালোবাসেন কেন?
— তুমি যে আমার স্বপ্নের রানি তাই।
— সারাজীবন আপনি কি আমাকে আপনার স্বপ্নের রারি করে রাখবেন?
রানী কেন রাখব না? তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বল?
আজিমের কথা শুনে মনোয়ারা আরও খুশি হয়। ধীর লয়ে পার হয়ে যায় আরও কিছুটা স্বপ্নে ভরা সময়। তারপর আসে বিদায়ের বেলা। দুজন চোখের জলে দুজনকে বিদায় জানায়। দুজনই ফিরে যায় নিজের বাড়ির পথে।
বাড়ি ফিরে আজিম ভাবে এই বাঁধভাঙা ভালোবাসার আকর্ষণে আজ রাতেওতো তার দুচোখে ঘুম আসবে না। আর রাত যত গভীর হবে ততই এই সুখ স্মৃতির পাশাপাশি দুঃখের দিনের স্মৃতি এসেও ভীড় জমাবে তার হৃদয়ের আঙিনায়। সে জানে না আজ রাতে কোন স্মৃতির ক্যানভাস তার চোখের সামনে উন্মোচিত হবে।
আস্তে আস্তে রাত গভীর হতে থাকে। ঘুমহীন চোখে সে অপেক্ষা করতে থাকে নতুন কোন স্মৃতির জানালা খোলার। হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যের মত ভেসে ওঠে নদী ভাঙনে সর্বশান্ত হওয়া গোহালবাড়ি গ্রামের মানুষদের জীবন চিত্র।
দুঃখের দিন বুঝি একেবারেই কাটতে চায় না। গোহালবাড়ি গাঁয়ের অসহায় দুঃখী মানুষদের জীবন তরী যেন একেবারেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছিল। প্রতিটা মুহূর্তই তাদের কাছে যেন কত যুগ বলে মনে হয়। তারপরও সময় কেটে যায়। ঘড়ির কাটার মতো টিক টিক করে পেরিয়ে যায় সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস, এক বছর, দুই বছর করে চার চারটি বছর। তারপর একদিন হঠাৎ করেই ঘটে যায় তাদের জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা। নয়শাল মালের কথাকে সত্যি প্রমাণ করে নদীর বুকে জেগে উঠে একটা বিশাল আকারের চর। প্রথমে যেন তারা নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালী আচরণে যে ঘটনাটি সত্যিই ঘটে গেছে তাতো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। গাঁয়ের ছোট বড় সবাই নদী তীরে গিয়ে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। এই আনন্দঘন মুহূর্তে তারা সবাই মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ নিয়ামতের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তার দরবারে হাজারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। চর জাগার বিষয়ে তাদের গাঁয়ের মাতবর নয়শাল মাল আগেই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। তাই প্রথমেই তারা তাকে এই আনন্দ সংবাদটি জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই খবর দেওয়ার জন্য তাই একদিন গাঁয়ের সব লোক টাটিপাড়া গ্রামের নয়শাল মালের নতুন বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। তাদের সবার চোখে মুখে তখন খেলা করছিল আনন্দের আলোকচ্ছটা।
সবার হাসিখুশি চেহারা দেখে নয়শাল মাল উৎফুল্ল চিত্তে জিজ্ঞাসা করে, তোমাদের চোখে মুখে এতো আনন্দ দেখে বুঝতে পারছি তোমরা আমাকে কোন সুসংবাদ দিতে এসেছো। বলো, কী বলতে চাও?
তখন তার ছোট বেলার বন্ধু মালু সরদার সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে, বন্ধু তোমার ভবিষ্যৎবাণী শতভাগ ফলে গেছে।
— কী ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেছে?
— তোমার ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী নদীর বুকে বিশাল আকারের চর জেগে উঠেছে।
— সত্য বলছ মালু?
— একশত ভাগ সত্য।
— কী মিয়ারা আমি বলেছিলাম না, আমরা আবার আমাদের হারানো সম্পত্তি ফেরত পাব। আবার আমরা সামাজিকভাবে একত্রে বসবাস করতে পারব। কি আমার কথা সত্যি হলোতো?
— এই দুরদর্শী দৃষ্টিশক্তির জন্যইতো গাঁয়ের সবাই তোমাকে মান্য করে। গাঁয়ের মাথা হিসাবে জানে।
— তা তোমরা বলো এখন আমাকে কী করতে হবে?
ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন তাগড়া যুবক বলে ওঠে, কী করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ করার জন্যই আপনার কাছে এসেছি।
— ঠিক বলেছো। সবাই মিলে পরামর্শ করেই সামনে এগুতে হবে। তার আগে একদিন আমি সরেজমিনে চরের বর্তমান অবস্থা দেখতে যেতে চাই। আর এই বিষয়ে আমি আর বিলম্ব করতে চাই না। আগামী শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আমি চর দেখতে যাব।
গাঁয়ের সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি বললো, আমরা এখনও আপনাকে গাঁয়ের মাতবর হিসাবে মান্য করি। নদীভাঙা মানুষদের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। ঐ দিন আমরা আপনার জন্য দুমুঠো ডাল ভাত খাওয়ার আয়োজন করব। সাথে সাথে আমরা গাঁয়ের সব মানুষ সামাজিকভাবে এই খানা খেয়ে আল্লাহর দরবারে শুকুর করব।
— এটাতো খুশির কথা। আমি তোমাদের দাওয়াত কবুল করলাম।
পরের শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়েই নয়শাল মাল গিয়ে হাজির হলো পদ্মা নদীর তীরে। সেখানে আগে থেকেই আশায় বুক বেঁধে হাজির হয়েছিল গাঁয়ের গৃহহারা, ভূমিহারা নিঃস্ব মানুষগুলো। নদীর বুকে চর জাগার আনন্দে আজ তারা চাঁদা তুলে নদীর তীরে নয়শাল মালসহ গাঁয়ের সকল মানুষের খাওয়ার আয়োজন করেছে। প্রথমে সবার মাঝে খাবার পরিবেশন করা হলো। অনেক দিন পর তারা আগের মত সামাজিকভাবে একসাথে খাবার গ্রহণ করল। খাওয়া শেষে কয়েকটি নৌকায় করে নয়শাল মাল, মাদু সরদারসহ গাঁয়ের মুরুব্বিরা চরের অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে বের হলো। নৌকা এসে ভিড়ল পদ্মার চরে। তারপর একে একে সবাই নৌকা থেকে নেমে পা রাখল তাদের স্বপ্নের নোঙড় ফেলার কোমল নরম মাটির বুকে। সবার চোখ থেকে ঝরে পড়ল আনন্দাশ্রু। ভিটেহারা, ফসলী জমিহারা নিঃস্ব মানুষগুলো শত দুঃখ, শত কষ্টের মধ্যেও যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে পার করেছে লক্ষ কোটি মুহূর্ত, দিন, মাস, বছর, আজ তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। স্বপ্নের ঠিকানায় পা রেখেই তারা আল্লাহর শোকর গুজার করার জন্য চরের পবিত্র মাটিকে জায়নামাজ বানিয়ে দু রাকয়াত নফল নামাজ আদায় করল।
তারপর শুরু হলো জেগে ওঠা এলাকা পরিদর্শন। সমস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে তার অনুমান করল, গাঁয়ে আগে যে পরিমান ফসলী জমি ছিল, মোটামুটি তার অর্ধেক জেগে উঠেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা আরও দেখতে পেল যে এই মৌসুম থেকেই এখানে ফসলের চাষ করা সম্ভব।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নিজের পৈত্রিক জমিও যদি নদী ভাঙনের পর আবার জেগে ওঠে তবুও তা সরকারি সম্পত্তি হয়ে যায়। তখন সেই জমি মালিকানা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ নিতে হয়। তাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো কার কী পরিমান জমি জেগে উঠেছে তা সঠিকভাবে যাচাই করে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ দলিল করে আনা। তারা জানে কাজটি বড় কঠিন। তারপরও নয়শাল মালের মতো একজন দক্ষ ও সৎ লোক থাকায় গাঁয়ের সবাই একবাক্যে তার উপরেই যার যার জমি চিহ্নিতকরণ এবং জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ দলিল করে আনার দায়িত্ব দিলেন। তার সাথে সহকারী হিসাবে কাজ করবে মালু সরদারসহ আরও কয়েকজন অভিজ্ঞ নির্লোভ প্রবীণ মানুষ।
বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার রবিশস্যের মৌসুম চলে এসেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফসল বুনতে হবে। তাই দেরি না করে পরের দিন থেকেই শুরু হয়ে গেল জমির মালিকানা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। দায়িত্বপ্রাপ্ত টিম এক সপ্তাহ ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করার পর কোন রকম আপত্তি ছাড়াই জমি চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া শেষ করার পর তাদের প্রত্যেকের নামে লিজ দলিল সম্পাদন করে দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর দরখাস্ত প্রদান করা হল। লিজ দলিল সম্পাদন একটি বিলম্বিত প্রক্রিয়া বিধায় তা চলমান রেখে তার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের তরফ থেকে যার যার জমি তাকে তাকে চাষ করার লিখিত অনুমতি দেওয়া হল। এই অনুমতিপত্র পাওয়ার পর নয়শল মাল সুষ্ঠুভাবে যার যার জমি তাদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলো।
তবে প্রতিদিন নাঙল, জোয়াল, গরু নিয়ে নদী পার হয়ে চরে গিয়ে জমি চাষ করা সম্ভব নয় বিধায় ছোট ছোট কুড়ে ঘর তুলে নাঙ্গল, জোয়াল গরু নিয়ে এসে সেখানে থেকে তারা হালচাষ শুরু করল। তারপর নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে শুরু হলো চরের চাষাবাদের কাজ। কৃষকের মুর্শিদী গানে মুখর হয়ে উঠল চরের আকাশ বাতাস। অল্প দিনের মধ্যের চরের উর্বর পলি মাটি ছেয়ে গেল কচি ফসলের সবুজ ডগায়। রবি শস্য উঠতে খুব বেশি দেরি হলো না। বহুদিন পর নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেয়ে সেখানে ফসল ফলাতে পেরে বাড়িহারা, ফসলি জমিহারা নিঃস্ব মানুষগুলোর হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল।
দয়াময় আল্লাহর অপার দয়ার কথা তারা কেমন করে ভুলবে? তাইতো গাঁয়ের সকল কৃষক আরও খোদাভীরু হয়ে উঠল। কয়েক বছরের মধ্যে আস্তে আস্তে চর আগের মতো পূর্ণতা লাভ করল। আগের মতো কৃষক তাদের পুরা জমি বুঝে পেল। দিনে দিনে চরের মাটি আরও শক্ত হলো। তখন নদীর তীর ও রাস্তার পাশ থেকে তাদের অস্থায়ী নিবাস সরিয়ে এনে গোহালবাড়ি চরেই গড়ে তুললো তাদের বসত বাড়ি। আর এভাবেই গোহলবাড়ি গাঁ রূপান্তরিত হলো গোহালবাড়ি চরে। এ যেন নতুন সভ্যতার গোড়া পত্তন।