একাত্তরের পরী : পর্ব-৫

(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)

৫.
আজিম ছিল চঞ্চল, উচ্ছল, ডানপিটে এক যুবক। সারা দিন মাঠে কাজ করা, বিকেলে লাঠি-খেলা আর সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করে তার দিনগুলো তরতরিয়ে পেরিয়ে যেত। কিন্তু সেই জীবনে কোন নারীর ভালোবাসার ছোঁয়া না থাকায় তা যেনো ছিল ছন্দহীন, বাঁধনহারা। সময়ের বিবর্তনে আজ তার জীবনে প্রেম এসেছে, মনের মানুষের অনুপ্রেরণায় তার জীবন স্বপ্নে ভরে উঠেছে। এখন সপ্তাহে অন্তত একদিন দুবন্ধু যায় তাদের মনের মানুষের সাথে দেখা করতে। দেখা হলে কথা হয়। কথা হলে হৃদয়-মন আনন্দে ভরে যায়।

আজও আজিম আর আবুল গিয়েছিল সুজানগর আর দাসপাড়া গাঁয়ের মাঝের ফাঁকা মাঠের ভেতরে তাদের প্রিয় মানুষদের সাথে দেখা করতে। সেখান থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আজিম আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছে। সে জানে আজ রাতে তার ভাল ঘুম হবে না। প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করার সুখ-স্মৃতির পাশাপাশি তার অতীত দিনের কষ্টের স্মৃতিগুলো তাকে সারা রাত জাগিয়ে রাখবে। আস্তে আস্তে রাত গভীর হতে থাকে। কিন্তু আজিমের চোখে কোন ঘুম নেই। তার মনের জানালায় এসে উঁকি দেয় গোহালবাড়ি গাঁ কিভাবে গোহালবাড়ি চরে রূপান্তরিত হলো— সেই করুণ কাহিনী।

আগেই আমরা জেনেছি বিংশ শতাব্দির পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্খাৎ ১৯৫৫ সালের দিকে কীর্তিনাশা পদ্মার প্রবল স্রােত একটু একটু করে গোহালবাড়ি গাঁয়ের ফসলি জমি গ্রাস করতে শুরু করে। পদ্মা নদীর এই তাণ্ডবের মুখে গাঁয়ের সাধারণ মানুষ ছিল একেবারে অসহায়। চোখের সামনে নদী গ্রাস করছিল বাপ দাদার ভিটে মাটি, ফসলি জমি। শুধু বেদনা-ভরা বোবা দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া প্রকৃতির এই দুর্যোগের প্রতিকার করার মতো কোন উপায় বা ক্ষমতা কোনটাই তাদের ছিল না। তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে গাঁয়ের প্রধান নয়শাল মাল এলাকার সকল কৃষকদের একত্রিত করে একটা বিশাল মিছিল নিয়ে ২০ মাইল দূরের পাবনা জেলা সদরে গিয়ে নদী ভাঙ্গন রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর একটা স্বারকলিপি প্রদান করেছিলেন। তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠানো যেমন মজবুত ছিল না, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের কোন সমস্যা সমাধানে সরকারেরও তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস প্রদান করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর প্রতিকারে সামান্যতম উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। ফলস্বরূপ একটি সমৃদ্ধ জনপদ ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পদ্মা নদীর অতল গহ্বরে।

এই নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রক্রিয়াটা এতোটাই বেদনাদায়ক ছিল যে তা শুনলে কোন বিবেকবান মানুষই চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে না। নদী প্রথমে গাঁয়ের ফসলি জমি গ্রাস করতে শুরু করে। গাঁয়ের কিছু গরীব মানুষ যাদের বসত বাড়ি ছাড়া ফসলি জমি ছিল না, তারা আগে থেকেই অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিত। যারা অবস্থাপন্ন কৃষক ছিল, ৫/১০ বিঘা জমি পদ্মার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার পরেও তারা সমস্যাটা খুব বেশি-একটা অনুভব করতে পারেনি। কিন্তু স্বচ্ছল পরিবারের অল্প জমির মালিকেরা যারা নিজেরাই বাড়িতে কামলা খাটাতো তারা নিজেদের ফসলি জমি হারিয়ে তখন পেটের দায়ে অন্যের বাড়িতে কামলা দেওয়ার কাজ শুরু করে দিল। সর্বনাশা পদ্মা যখন গাঁয়ের সকল ফসলি জমি গ্রাস করে ফেললো তখন গাঁয়ে হাহাকার পড়ে গেল। কৃষকের হাতে কোন সময়ই নগদ টাকা থাকে না। তারা হালচাষ করে যে ফসল ফলায় তা দিয়ে যেমন পেটের ক্ষুধা নিবারণ হয়, সেই ফসল বিক্রি করেই নিত্য প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিসপত্র ক্রয় করতে হয়। দুদিন আগেও যে কৃষককে অবস্থাপন্ন ধনী বলা হতো, ফসলি জমি হারিয়ে সে যেন একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল। হাতে টাকা নেই। কাজ করার সামর্থ বা সুযোগ কোনটাই নেই। অথচ পরিবারের ১০/১২ সদস্যের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে। বৌয়ের গায়ের গয়না, বাড়ির নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র— কলস, থালা, ঘটি, বাটি, ঘরের টিনের চালা বিক্রি করে সংসারের খরচ চালানো শুরু করলো। এতো কষ্টের মধ্যেও তাদের বড় সান্ত্বনা ছিল সারা দিন পর অন্তত একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে।

ফসলি মাঠ শেষ করে নদী গাঁয়ের একটির পর একটি বাড়ি গ্রাস করতে শুরু করল। যেদিন যে বাড়ির গাছপালা, ঘরবাড়ি একটু একটু নদীগর্ভে বিলিন হতে শুরু করত, সেদিন সে বাড়ির ছেলে বুড়ো, যুবকদের আর্তচিৎকারে এলাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠত। কিন্তু তাতে সর্বনাশা পদ্মার কোন মায়া হতো না। আর এভাবেই একদিন গাঁয়ের ধনী গরীব নির্বিশেষে সকলে আশ্রয়হারা হয়ে পথের ভিক্ষুকে পরিণত হয়ে গেল। নয়লাশ মালসহ গাঁয়ের অল্প কিছু মানুষ, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করত এবং হাতে নগদ টাকা ছিল, তারা টাটিপাড়া গাঁয়ে জমি কিনে নতুন বাড়ি তৈরি করে সেখানে আশ্রয় নিল। অন্যরা বসত বাড়ি হারিয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় আশ্রয় গ্রহণ করবে, তাদের মুখে কিভাবে দুমুঠো খাবার তুলে দিবে এই চিন্তায় তারা যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই নয়শাল মাল এই সব অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাদের সবাইকে সাধ্যমত সাহায্য কররেন। এই বিপদের দিনে সব চেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন তা হলো পাশে থেকে সান্ত্বনা দেওয়া, আশার বাণী শুনিয়ে সাহস জোগানো। এই কাজটি তিনি খুব ভালোভাবে করলেন। তিনি সবাইকে বললেন, তোমরা হতাশ হয়ো না। বিপদের দিনে বেশি বেশি আল্লাাহকে স্মরণ করো। যে আল্লাহ বিপদ দিয়েছেন, তিনিই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। তিনি দয়া করলে যে নদী তোমাদের বসত বাড়ি, ফসলের জমি গ্রাস করেছে, দেখো একদিন সেই নদীই তোমাদের সব কিছু ফিরিয়ে দিবে। ঐ যে গানে শোননি, ’নদীর একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে, এইতো নদীর খেলা’। এখন তোমরা নদীর তীরে, রাস্তার ধারে অস্থায়ী বাড়ি তৈরি করে থাকা শুরু কর। কেউই বেশি দূরে চলে যেয়ো না। আমি এখনও বিশ্বাস করি, আমাদের বাড়ি, আমাদের ফসলের জমি আবার আমরা ফিরে পাবো।

নয়শাল মালের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যে দিশেহারা মানুষগুলো আশার আলো দেখতে পেল। তারা রাস্তার ধারে, নদী তীরে অস্থায়ী বাড়ি তৈরি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করে দিল। কিন্তু কিভাবে পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিবে? কথায় আছে না পেটের ক্ষুধা মানুষের লাজ-লজ্জা কেড়ে নেয়। যে সব অবস্থাপন্ন কৃষক নিজে কোন দিন কাজকর্ম করেনি, তারাই কাজের সন্ধানে বের হলো। ফসলি জমি না থাকায় এলাকায় কৃষি শ্রমিকের কোন কাজ নেই। তাই কেউ মাছ ধরা, কেউ নৌকা চালালো, কেউ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রি করে সংসার চালনো শুরু করল। কথায় আছে না, সময় আর নদীর স্রােত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই দুঃখের দিনেও খেয়ে না খেয়ে নদী ভাঙ্গনে সর্বশান্ত গোহালবাড়ি গাঁয়ের অসহায় মানুষগুলোর দিন পার হতে থাকল। কিন্তু তারা কেউ এলাকা ছাড়লো না। কারণ নয়শাল মাল যে তাদের বুকে আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন। একদিন নদী ফিরে দিবে তাদের বসত ভিটা, ফসলি জমি। তাইতো তারা মাঝে মাঝে নদীর তীরে গিয়ে বোবা দৃষ্টি মেলে চুপি চুপি সর্বনাশা নদীর সাথে কথা বলতো। জিজ্ঞাসা করতো আর কত দিন লাগবে তাদের ভিটে মাটি, ফসলি জমি ফিরে পেতে।

পরের বছরে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর নদীর অনেক স্থানেই ছোট ছোট চরের মত জেগে উঠতে দেখা গেল। গাঁয়ের সবাই তখন আশাবাদি হয়ে উঠল— বুঝিবা চর জাগার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু না। পরের বছরের আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ারের পানি এসে সেই সব ছোট ছোট চরের পাশাপাশি আশাবাদি মানুষদের স্বপ্নকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তবুও তারা হতাশ না হয়ে আশায় বুক বাঁধল, একবার যখন মাটি জমা শুরু হয়েছে, নিশ্চয়ই একদিন চর জাগবেই। আবার তারা নিজেদের জমিজমা চাষ করে পরিবারের সকলের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে পারবে। শেষ হবে তাদের দুঃখে ভরা অনিশ্চিত জীবনের।

শেয়ার করুন:

Recommended For You

About the Author: জিয়াউল হক