একাত্তরের পরী : পর্ব-৪

(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)

৪.

গত কয়দিন আজিম ও আবুলের মন ছিল দুঃখ ভারাক্রান্ত। কারণ বালিয়াডাঙ্গী স্কুল মাঠে লাঠি খেলতে গিয়ে তারা দুজন একসাথে দুই ষোড়শী নারীর রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোথায় তাদের বাড়ি, কী তাদের নাম— তার কিছুই জানা ছিল না। কয়েক দিন ধরে কয়েকটি স্কুলে ঘুরাঘুরি করার পর আজই প্রথম যেমন তাদের সন্ধান পাওয়া গেছে তেমনি তাদের সাথে ভাব বিনিময় করাও সম্ভব হয়েছে। তাইতো আজ আজিমের মন আনন্দে ভরপুর। সে ভেবেই পায় না, সমতলের মেয়ে হয়েও কোন অহঙ্কার না করে মনোয়ারা যেভাবে তাকে আপন করে নিয়েছে, তা এককথায় তুলনাহীন। এতে তার প্রতি মনোয়ারার গভীর ভালোবাসার পাশাপাশি তার বড় মনের পরিচয়ও ফুটে উঠেছে। আজকের এই আনন্দঘন মুহূর্তে তার মনে বার বার করে একটা কথাই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। তাহলো তারাও একদিন সমতলের বাসিন্দা ছিল। কীর্তিনাশা পদ্মার নিষ্ঠুর থাবায় বাপ দাদার ভিটে মাটি হারিয়ে আজ তারা গোহালবাড়ির চরের বাসিন্দা হয়েছে। তাই বলে তাদেরকে কেন ঘৃণার চোখে দেখা হয়? কেন তাদের ছোট লোক বলে অবজ্ঞা করা হয়? এই কথা ভাবতে ভাবতে সে হারিয়ে যায় বাবার মুখ থেকে শুনা গোহালবাড়ি গ্রামের অতীত ইতিহাসের অন্তরালে।

আজকের গোহালবাড়ির চর কিন্তু আগে চর ছিল না। ব্রিটিশ আমল থেকে গোহালবাড়ি গ্রাম ছিল কীর্তিনাশা পদ্মা নদীর তীরে একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। এ গ্রামেই ছিল নয়শাল মাল ও আজিমের বাবা মালু সরদারের চৌদ্দ পুরুষের বসত বাড়ি। এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিল কৃষক। তারা জমিতে ধান, পাট, আখ, পেঁয়াজ, রসুন প্রভৃতি ফসলের চাষ করতো। অন্যান্য গাঁয়ের তুলনায় এ গাঁয়ের পদ্মা বিধৌত উর্বর পলি মাটিতে ফসলের ফলন অনেক বেশি হতো। আর তাই সমতল এলাকার চেয়ে এ গাঁয়ের কৃষকেরা ছিল সচ্ছল। নয়শাল মাল ছিল এই গাঁয়ের প্রধান। অবস্থাপন্ন ব্যক্তি। তার ছিল ২০০ বিঘা জমি। ১০ জন কৃষাণ ১০ জোড়া বলদ দিয়ে ১০টা লাঙ্গল দ্বারা তিনি জমি চাষ করতেন। হালচাষের পাশাপাশি তার ছিল মহাজনি কারবার। তখন এলাকায় প্রচুর পরিমান পাট চাষ হতো। বেড়া থানার যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত নাকালিয়া বাজার ছিল সব চেয়ে বড় পাটের মোকাম। নয়শাল মাল গাঁ থেকে সস্তা দামে সেই পাট কিনে নিজের মহাজনি নৌকায় করে নাকালিয়া মোকামে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে ফিরতি পথে নগরবাড়ি ঘাট থেকে কম দামে নিত্য প্রয়োজনীয় মালপত্র কিনে এনে তা পাইকারি দামে স্থানীয় দোকানদারদের কাছে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত। নিজের জমিতে কৃষিকাজ এবং মহাজনি নৌকায় দ্বিমুখী ব্যবসা করে দিন দিন তার সম্পদের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এলাকার উর্বর জমিতে ভালো ফসল ফলায় মালু সরদারসহ গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের আর্থিক অবস্থাও মোটামুটি সচ্ছল ছিল।

এতো সম্পদশালী হয়েও নয়শাল মাল ছিল আমুদে স্বভাবের মানুষ। হাসিখুশি স্বভাবের জন্য সব সময় তার পাশে লোকের ভীড় জমে থাকত। তার পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামে একটা যাত্রা গানের দল ও একটা লাঠি খেলার দল গড়ে উঠেছিল। গানের দলের সুনাম বৃদ্ধির জন্য যেমন তিনি একজন সংগীত মাস্টার রেখেছিলেন, তেমনি লাঠিয়াল দলের পারদর্শিতা বৃদ্ধির জন্য একজন বিখ্যাত লাঠিয়ালকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে, সত্যি কথা বলতে কী— নদীর তীরের গোহাইলবাড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষদের জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে তিনি গানের দলের চেয়ে লাঠিয়াল দলকেই বেশি পৃষ্টপোষকতা করতেন। বর্ষার পানিতে যখন নদীর দুকূল উপচিয়ে প্লাবন শুরু হতো, তখন সাধারণ কৃষকদের হাতে কোন কাজ থাকত না। শরতের সেই অলস দিনে লাঠি খেলার ধুম পড়ে যেত। আবার অঘ্রানের ধান কাটা শেষে প্রকৃতিতে যখন শীতের হিমেল হাওয়া প্রবাহিত হতো, তখনই শুরু হতো যাত্রা পালা। গাঁয়ের কৃষকেরা তখন রাত্রি জেগে রূপভান যাত্রা, সাগরভাসা পালাসহ আরও অনেক যাত্রা গান শুনত। তিনি ছিলেন গরিবের বন্ধু। প্রায়ই এলাকার গরিব মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ভাদ্র মাসে আউস ধান ও অঘ্রানে আমন ধানের খন্দ ওঠার পর তিনি গাঁয়ের সব মানুষদের এক বেলা দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের তিনি দুহাত ভরে সহযোগিতা করতেন। মালু সরদারের সাথে ছিল তার গলায় গলায় ভাব। গ্রামের যে কোন সালিশ দরবারে দুজন পাশাপাশি বসতেন। দুজন পরামর্শ করেই গ্রামের বিচার-আচার পরিচালনা করতেন।

মালু সরদার ছিল নয়শাল মালের ছোট বেলার বন্ধু। তার আর্থিক অবস্থাও বেশ সচ্ছল ছিল। তারও ছিল ৫০ বিঘা জমি। কিছু জমি নিজে চাষ করতেন। বাকি জমি ভূমিহীন কৃষকদের কাছে বরগা দিয়ে সেখান থেকে অর্ধেক ফসল পেতেন। তাতে তার সংসার ভালোভাবেই চলে যেত। অনেক আশা করে ছেলে আজিমকে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু ডানপিটে স্বভাবের আজিমের লেখাপড়ার প্রতি কোন মনোযোগ ছিল না। বই-খাতা নিয়ে স্কুলে গিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। মানুষের গাছের ফল পেড়ে খেত। কোন গাছে কোন পাখি বাসা বেঁধেছে, কোন বাসায় পাখি ডিম পেড়েছে, কোন বাসায় পাখির বাচ্চা ফুটেছে তা ছিল তার নখদর্পণে। গাঁয়ের লোকজন প্রায়ই মালু সরদারের কাছে এসে ছেলের নানা অপকর্মের বিষয়ে নালিশ জানাত। তিনি ছিলেন শান্তশিষ্ট নির্বিবাদী মানুষ। ছেলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগে খুব বিব্রত হতেন। ছেলেকে অনেক শাসন করতেন। কিন্তু তার স্বভাবের কোন পরিবর্তন হতো না। দুঃখ করে বিষয়টি একদিন বন্ধু নয়শাল মালের কাছে খুলে বললে, তিনি বলেন— তোমার ছেলে একটু ডানপিটে স্বভাবের। লেখাপড়ায় মন না বসলেও ওর মধ্যে কাজ করার একটা অদম্য শক্তি আছে। দেখো, সে ভালোভাবেই তোমার সংসারের হাল ধরতে পারবে। তাই স্কুলে না পাঠিয়ে নিজের সাথে রেখে হাল চাষের কাজে তালিম দিতে শুরু করো। এতে মানুষের অভিযোগের হাত থেকেও রক্ষা পাবে, আবার নিজের কাজেরও কিছুটা সহায়তা পাবে। তারপর বন্ধুর পরামর্শ মতো মালু সরকার আজিমকে স্কুলে না পাঠিয়ে নিজের সাথেই হালচাষের কাজে লাগিয়ে দেয়। এতে আজিমও বেশ খুশি মনে কাজে মনোযোগী হয়ে উঠতে থাকে।

গোহাইলবাড়ি গ্রামের প্রতিটা মানুষের মধ্যেই ছিল আন্তরিক সদ্ভাব। বৈশাখ মাসে বৈশাখি মেলার পাশাপাশি বাজারের প্রতিটা দোকানে হালখাতা হতো। কৃষকদের হাতে সব সময় নগদ টাকা পয়সা থাকত না। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে হত। তাই নগদ কিংবা বাকিতে বছরব্যাপি পরিচিত দোকান থেকে তারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করত। দোকানদার এবং কৃষক সবাই জানত দোকানে যতই বাকি থাকুক পহেলা বৈশাখের হালখাতার দিনে সব বাকি তাদের শোধ করতে হবে। হালখাতার দিনে হালখাতা করার পর তাদের পেট পুরে মিষ্টি খাওয়ানো হত। তাছাড়া দুই ঈদ এবং আউস ও আমন মৌসুমের খন্দ উঠার পর প্রত্যেকেই পাশের বাড়ির লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়াত। ছেলের বিয়ে, মেয়ের বিয়ে, খাতনা অনুষ্ঠানসহ পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানে তারা একে অন্যকে দাওয়াত দিত।

গোহালবাড়ি গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য ছিল অপরূপ সুন্দর। গাঁয়ের প্রতিটা বাড়িই ছিল গাছগাছালিতে ভরা। উত্তরে ছিল বিশাল বনভূমি আর দক্ষিণ পাশে ছিল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। বনভূমিতে ঘুঘু, বুলবুলি, শ্যামা, দোয়েল, শালিক, টিয়া, টুনটুনিসহ নানা রঙের পাখি বাস করতো। দিনভর তাদের কলকাকলিতে সারা বনভূমি মুখর হয়ে থাকত। আর দক্ষিণের উর্বর জমিতে প্রচুর পরিমান ধান, পাট, আখ, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর, খেসাড়িসহ নানা প্রকার ফসল ফলত। প্রতিদিন সকালে কৃষক তাদের নাঙল জোয়াল গরু নিয়ে মাঠে যেত হালচাষ করতে। বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে প্রথম বৃষ্টি হলেই তারা জমিতে আউস ধান ও পাটের বীজ বপন করত। তারপর তারা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করত। যে বছর বেশি বৃষ্টি হতো সে বছর ভাল ফসল ফলত, আর যে বছর কম বৃষ্টি হতো সে বছর ফসল তেমন ভাল হতো না। বর্ষার বানের পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে চাষ না করেই খেসাড়ির বীজ বুনে দেওয়া হতো। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পলি মাটিতে গজিয়ে উঠত চারা গাছ। যতই দিন যেত ততই তা আরও গাড়ো সবুজ হয়ে ভরে যেত সারা প্রান্তর । সেই ফসলি মাঠের পাশ দিয়েই এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মা নদী। বর্ষায় যখন কৃষকের হাতে কাজ থাকত না, তখন জেলেদের পাশাপাশি সাধারণ কৃষকরাও পদ্মা নদীতে মাছ ধরতে যেত। গ্রামের প্রতিটা মানুষ মিলেমিশে বাস করত। তাইতো ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামের প্রতিটা মানুষই ছিল সুখী। আশেপাশের ১০ গাঁয়ের মধ্যে গোহারবাড়িই ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রাম।

শেয়ার করুন:

Recommended For You

About the Author: জিয়াউল হক