সমস্যায় জর্জরিত লক্ষ্মীপুর বিসিক 

লক্ষ্মীপুর বিসিক নানান সমস্যায় জর্জরিত। বড় বড় গর্ত, খানাখন্দে বেহাল লক্ষ্মীপুরের বিসিক শিল্পনগরী এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে পানি নিষ্কাশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থাও। চলতি বর্ষায় এ সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এছাড়া পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে শিল্পনগরী। সম্ভাবনা সত্ত্বেও লোকসানের মুখে এখন বন্ধ হওয়ার পথে ৭টি কারখানা।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ না থাকায় সমস্যা লাঘব করা যাচ্ছে না।

এদিকে রায়পুর উপজেলায় আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে প্রায় ২২ একর সম্পর্ত্তি বেহাল অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিসিক-এর ভবন। সরকারি এই স্থাপনা দ্রুত ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট করে বেকার ও শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান-এর ব্যবস্থা করলে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে দেশের চাকা বলে জানান ৫নং চরপাতা ইউপি চেয়ারম্যান সুলতান মামুনুর রশিদ।

সরেজমিনে বিসিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ২০ বছরেও বিসিক এলাকায় গড়ে ওঠেনি উল্লেখযোগ্য কোনো ব্র্যান্ডিং শিল্প কারখানা। বিসিকের প্রবেশ পথেই কার্পেটিং উঠে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। ভেতরে ৭টি রাস্তার প্রতিটির বেহাল দশা। সড়কের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত, যেখানে পানি জমে পরিণত হয়েছে পুকুর। সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু সমান পানি জমে। ফলে অনুপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থায় চলাচলে বিঘ্ন ঘটে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় মালিকপক্ষ ও আগত ব্যবসায়ীদের। যাতায়াত করতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে মালবাহী গাড়ির চেসিসসহ যন্ত্রাংশ।

এদিকে পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো খুবই সরু। বিভিন্ন স্থানে কারখানার পরিত্যক্ত ময়লা ও বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন না হয়ে জমে আছে। এ ড্রেনগুলো পরিচ্ছন্নতার অভাবে পুরো বিসিক এলাকা জুড়ে দুর্গন্ধের নর্দমায় পরিণত হয়ে আছে। এতে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগ-জীবানু।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বেকার সমস্যা সমাধান ও শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে লক্ষ্মীপুর শহরে ১৬.০৭ একর ভূমির উপর বিসিক শিল্প নগরী গড়ে তোলা হয়। ২০০০ সাল থেকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। অফিস, ড্রেনেজসহ অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পের ৬.২৫ একর ভূমিতে নির্মাণ করা হয়। বাকি ৯.৯১ একর ভূমিতে তৈরি করা হয় তিন ক্যাটাগরির ৯৯টি প্লট। এর মধ্যে ৫৬টি (প্রকল্প) ইউনিটের বিপরীতে এসব প্লট বরাদ্দ হয় ৯২টি (প্রকল্প) ইউনিট চালু রয়েছে। ৭টি উৎপাদন জনিত কারণে বন্ধ রয়েছে। অনেক ইউনিট সময় মতো চালু না হওয়ায় বিসিকের ঊর্ধ্বতন ল্যান্ড এলোটমেন্ট কমিটি (এলএসি) থেকে বাতিলের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা যায়নি।

আরও জানা যায়, শিল্পনগরীতে যেসব কারখানা গড়ে উঠেছে সেগুলোর মধ্যে বেকারি, অয়েল মিল, জৈবসার কারখানা, সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অটো রাইস মিল, মবিল রি-প্যাকিং ফ্যাক্টরি, শামসুন্নাহার মাল্টি রিসাইক্লিংসহ চালু রয়েছে মাত্র ১৮টি প্রতিষ্ঠান। বিস্কুট উৎপাদন বেকারি রয়েছে ১২টি। এসব কারখানায় বছরে প্রায় শত শত কোটি টাকা টার্নওভার হলেও বর্তমানে যোগাযোগ ও ড্রেনেজ সমস্যার কারণে অধিক লোকসানে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, বিসিক এলাকায় ব্যবহারের অনুপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থা, পানি বিদ্যুৎ গ্যাস ও ড্রেনেজ সমস্যার কারণে লোকসানের ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে শিল্পায়ন গড়তে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইছে না। অপরদিকে কিছু প্লটে পরিকল্পনা মোতাবেক অবকাঠামো গড়ে উঠলেও শুধুমাত্র যোগাযোগ ও ড্রেনেজ সমস্যার কারণে তা চালু হচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত সরকারের সু-দৃষ্টি কামনা করেন স্থানীয়রা।

বিসিক শিল্পনগরীর সৌদিয়া বেকারির ম্যানেজার সাঈয়েদ আলম জানান, নামে শিল্পনগরী। এখানে কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই। রাস্তাঘাটের যে দশা, সময় মতো পণ্য বাজারে পাঠানো যাচ্ছে না। এতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কারখানা মালিকদের। এ থেকে রেহাই পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

জমি বিক্রয় ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাটি শুরু করেন মেসার্স চৌধুরী অটো সয়াবিন অ্যান্ড রাইস মিল কারখানার পরিচালক মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন। অথচ অব্যাহত সমস্যার কারণে লোকসানে পড়ে তার এ প্রতিষ্ঠানটি এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন জানান, বিদ্যুত, গ্যাস, পানি ও রাস্তার বেহাল দশার কারণে ঠিক মতো কারখানার কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। অধিক লোকসানের মুখে কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। পুরো বিসিকের যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হয়ে আছে। কর্তৃপক্ষ যেন দেখেও দেখে না।

আমিরাত লুব অয়েল নামের মবিল কারখানার দুজন কর্মকর্তা জানান, শিল্পনগরীর সর্বশেষ অংশে মবিল কারখানা। সবগুলো রাস্তা ঘুরে এ কারখানায় আসতে হয়। রাস্তাটিতে যাতায়াত করতে কষ্ট হয়। গাড়ি চালক অতিরিক্ত ভাড়া ছাড়া বিসিক এলাকায় প্রবেশ করে না। এতে যাতায়াত খরচ বেড়ে বিক্রয়ের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।

লক্ষ্মীপুর শিল্পনগরীর অফিস সূত্রে জানা যায়, কর্মসংস্থানের দিক থেকে বিসিকের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান নেক্সট ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। এখানে প্রায় ৫শ’ জন শ্রমিক, অন্য আরো ৩-৪টি প্রতিষ্ঠানে ৩০-৪০ জন হারে কর্মচারী রয়েছে। বাকি চালু প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৪-৫ জন হারে শ্রমিক রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিকের একজন উদ্যোক্তা জানান, নেক্সট ফুড আশপাশের অনেক প্লট কিনে নিয়েছে। লক্ষ্মীপুর বিসিক এখন ৩-৪টি কোম্পানির অধীন চলে যাচ্ছে। তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বজায় নেই বলে জানান তিনি।

লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্প নগরীরর উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত গিয়ার ওয়েল রিপ্যাকিংয়ের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাইরে কোনো নাম কিংবা সাইনবোর্ড নেই। ভেতরে গিয়ে বোতলে লাগানো একটি লেভেল থেকে জানা গেল প্রতিষ্ঠানটির নাম সিটি লুব ওয়েল ইন্ডাস্ট্রি লি.। ইংরেজি ও আরবিতে লেখা ওই লেভেলের কোথাও ঠিকানা হিসেবে লক্ষ্মীপুর বিসিকের নাম লেখা নেই। নেই বিএসটিআই-এর সিলও।

বিসিকি শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ রহিম জানান, এখানে নানা সমস্যা রয়েছে। যোগাযোগ, ড্রেনেজ সমস্যার পাশাপাশি এলাকার ল্যাম্পপোস্টগুলোতে নেই লাইট। রাতের বেলায় অন্ধকারে চলাচল করতে হয়। এছাড়াও সীমানা প্রাচীর না থাকায় পুরো বিসিক এলাকা নিরাপত্তাহীন থাকে। বার বার সমস্যার কথাগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

এ বিষয়ে সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, শিল্পনগরী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রাকিব উদ্দিন জানান, বিসিকে যে সমস্যা, সে তুলনায় বরাদ্দ খুবই সামান্য। তাই সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। বেহাল সড়ক সংস্কারের জন্য ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং ড্রেন ও কালভার্টের জন্য ৭৬ লাখ টাকার চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছে। শীগ্রই টেন্ডার পক্রিয়া অনুসরণ এসব সমস্যার সমাধান করে সমস্যার সমাধান করা হবে । বিদ্যুৎ, ডাস্টবিন ও বড় ড্রেনেজ সিস্টেম-এর নির্মাণ করার দায়িত্ব লক্ষ্মীপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষের। লক্ষ্মীপুর বিসিকে বরাদ্দপ্রাপ্ত সব প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে গেলে প্রায় ১০ হাজার মানুষ কাজ পেতো। প্রথমে কিছু অব্যবস্থাপনা হলেও বর্তমানে কোন অনিয়ম নেই এবং সব প্লটে শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য তারা কারখানা মালিকদের তাগাদা দিচ্ছেন।

লক্ষ্মীপুর জেলা বিসিক এর উপব্যবস্থাপক মো. আসাদুল্লাহ হাসান বলেন, বিসিক শিল্পনকারীরে মোট প্লটসংখ্যা ৯৯টি, বরাদ্দকৃত প্লট- ৯৯। শিল্প ইউনিট সংখ্যা ৫৬টি চালু এবং নির্মানাধীন/ বাস্তবায়নাধীন ১১টি। রুগ্ম রয়েছে ৭টি। এছাড়াও ২০২২/২৩ অর্থ বছরে সরকারকে প্রদত্ত রাজস্বের পরিমাণ ছিলো ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অনেকগুলো বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ড্রেনেজ সমস্যা ও লাইটিং সমস্যা ছাড়া তেমন কোন সমস্যা নেই। রায়পুরের পরিত্যাক্ত বিল্ডিং ভেঙ্গে সেখানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন:

Recommended For You