বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে ঢাকা

প্রাণঘাতি হয়ে উঠেছে বায়ু দূষণ। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবারও বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ছিল ম্যাগাসিটি ঢাকা। বায়ুর মান চরম অস্বাস্থ্যকর। এদেশে বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে উন্নত হয়। কিন্তু এবছর সেই চিত্র মিলছে না। বর্ষার পানিও দূষণ কণার কাছে হার মানছে।

গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদনে বায়ু দূষণের ভয়ংকর তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছে। এতে বলা হয়েছে-বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশে পরিণত হয়েছে। এই দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় ৬ দশমিক ৮ বছর। এলাকা ভেদে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজীপুর দেশের সবচাইতে দূষিত জেলা। কেবল বায়ু দূষণে এই জেলায় বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৮ দশমিক ৩ বছর। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ু দূষণ বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। সামগ্রিকভাবে দূষিত বায়ু মানুষের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। তবে দূষণ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বিশ্বের ছয়টি দেশে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন,

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। তবে গ্রামের বায়ুর মান বড় শহরগুলোর তুলনায় ভাল। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে ৭ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ বসবাস করে। এসব শহরের অধিবাসীদের গড় আয়ু সাত বছর ছয় মাস কমে যাচ্ছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করে বায়ুর মান উন্নত করলে গড় আয়ু বাড়ানো যেতে পারে। ঢাকায় বায়ুর মান উন্নত করে গড় আয়ু আট বছর এক মাস বাড়ানো সম্ভব, আর চট্টগ্রামে ৬ বছর ৯ মাস সঙ্গে পুরো দেশের গড় আয়ু বাড়তে পারে পাঁচ বছর আট মাস।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের তুলনায় বায়ু দূষণ ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। আর এতে গড় আয়ু ২ বছর ৮ মাস কমেছে। তবে ২০২০ ও ২০২১ সালের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে কম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-২.৫ থাকতে হবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মল বায়ুর জেলা সিলেটেও এর চেয়ে বেশি মাত্রায় বায়ুদূষণ থাকছে। ওই জেলাতেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রায় ১০ গুণ বেশি। আর বাংলাদেশের নিজস্ব মানমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে,গড় আয়ু বিবেচনায় বায়ু দূষণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হৃদরোগের পরেই দ্বিতীয় বড় হুমকি। এর প্রভাব ধূমপানের চেয়ে মারাত্মক। তামাক সেবনের কারণে গড় আয়ু যেখানে কমে যাচ্ছে ২ দশমিক ১ বছর, যখন শিশু এবং মাতৃ অপুষ্টি গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে ১ দশমিক ৮ বছর, বায়ু দূষণের প্রভাব দেখা যাচ্ছে এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি। এর মধ্যে ধূমপানে মৃত্যুর চেয়ে তিন গুণ, সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর তুলনায় ৫ গুণ মানুষ বায়ুদূষণে মারা যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বায়ুর মান বিষয়ে নির্ভরযোগ্য ও সময়মতো তথ্য সরবরাহের ওপরে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এসব তথ্য যাতে দূষিত বায়ু থেকে রক্ষা পেতে নাগরিকেরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে,তা-ও নিশ্চিত করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। এ কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারলে বাংলাদেশে বায়ুর মানের উন্নতি হতে পারে এবং গড় আয়ুও কমতে পারে বলে মতামত দেওয়া হয়েছে।

এদিকে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যপস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড.আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, দূষণের মধ্যে বায়ু দূষণের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। বায়ু দূষণের কারণে ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে:নাক-মুখ জ্বালাপোড়া, মাথা ঝিমঝিম ও ব্যাথা করা, বমি বমি ভাব। অন্য দিকে ফুসফুসে ক্যান্সার, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মা, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, হার্ট অ্যাটাক, চর্মরোগ ইত্যাদিসহ অনেক রোগের মূল কারণ বায়ু দূষণ। এই দূষণের ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে সারাবিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়

শেয়ার করুন:

Recommended For You