রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উর্ধমুখী জন্মহার হতে পারে মাথা ব্যথার কারণ

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর দিন দিন রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে বারবার উঠলেও সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বের হচ্ছে না। এদিকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯৫টি শিশু জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ, ৪ জন করে শিশু জন্মগ্রহণ করে প্রায় প্রতিঘণ্টায়। তাই রোহিঙ্গা সংকটে নতুন করে মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে তাদের উর্ধমুখী জন্মহার। বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন অবস্থান করছে প্রায় ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা। যা কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ছুঁই ছুঁই।

সোমবার (২৮ আগস্ট ২০২৩) উখিয়ার বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, রাস্তাঘাট, বাজারসহ জনবহুল স্থানে তরুণ ও বয়স্ক রোহিঙ্গাদের চেয়ে শিশুদের উপস্থিতিই বেশি। বিভিন্ন বয়সী শিশু। বয়সে একটু ছোট শিশুদের গায়ে জামা–কাপড়, এমনকি বেশির ভাগ শিশুর পরনে হাফপ্যান্ট পর্যন্ত নেই। বেশ কিছু মেয়েশিশুকেও খালি গায়ে ঘুরতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, (৩১ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত হালনাগাদ) আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৭ জন। পরিবার আছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০৩টি। এর মধ্যে ৩ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১০ জনের বেশি। ১০ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৮ থেকে ৯ জন। ২৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ থেকে ৭ জন। ২৮ শতাংশ পরিবারে সদস্যসংখ্যা ১ থেকে ৩ জন। গড়ে প্রতি পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫। আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর।

এছাড়াও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন উঠে এসেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯৫টি শিশু জন্ম নেওয়ার। সম্প্রতি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

সরকারি হিসেবে প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু জন্ম নেয় ক্যাম্পে। এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, গেলো ছয় বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে ১ লক্ষ ৫০ হাজার শিশু। এরমধ্যে কমেছে খাদ্য সহায়তায়ও। যা সংকটকে আরো বেশি জটিল করছে বলে মনে করেন শরণার্থী কমিশনার।

জানা যায়, ক্যাম্পে অধিকাংশ পুরুষ রোহিঙ্গার একাধিক স্ত্রী রয়েছে। তারা সন্তান জন্মদানকে আল্লাহর দান বলে মনে করেন। যেকোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণেও রয়েছে তাদের চরম অবহেলা।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী আয়েশা বলেন, আমার ছয় সন্তান এবং বর্তমানে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান বেশি হওয়ায় সংসারে তেমন অভাব নেই। কারণ ছেলেরাও আয়-রোজগার করছে।

এদিকে একই ক্যাম্পের ৭ সন্তানের জননী খুলগুছ বেগমকে আরও সন্তান নেয়ার ইচ্ছে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহ চাইলে ও তার স্বামীর ইচ্ছা থাকলে ছেলে মেয়ে বেশি হলে দোষ কী? তিনি আরও জানান, চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে নিজের শরীর ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছেন।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গারা সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য। ক্যাম্পে অবস্থানরত অনিশ্চিত জীবনেও থেমে নেই তাদের সন্তান নেয়ার প্রবণতা। গত সাড়ে ছয় বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় দেড় লাখ শিশু জন্মলাভ করেছে। অশিক্ষিত রোহিঙ্গারা ধর্মের দোহাই দিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণে অনাগ্রহী। বেশি সন্তান জন্মদান শারীরিকভাবে ক্ষতিকর জানলেও তারা তা মানছেন না। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাড়ছে একাধিক বিয়ে করার প্রবণতাও।

বালুখালি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আবুল হাসেম জানান, তার স্ত্রী রয়েছেন দু’জন। দুই সংসারে রয়েছে ১৩ সন্তান। তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তারও রয়েছে ৩ সন্তান।

কক্সবাজারের সহকারী সিভিল সার্জন ডা. মহিউদ্দিন আলমগীর এ বিষয়ে বলেন, ক্যাম্প জীবনে তেমন কোনো বিনোদন না থাকায় রোহিঙ্গাদের জন্মহার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সরকারের পক্ষ থেকে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে রোহিঙ্গা নারীদের পরামর্শ দিচ্ছে।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, কোনো রোহিঙ্গাদের আপনারা আশ্রয় দিবেন না, তাদেরকে কোনো কাজ ব্যবহার করবেন না। কারণ তাদেরকে সুযোগ দিলে একসময় জেলা জুড়ে রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে, আমরা হয়ে যাবো সংখ্যালঘু।

এদিকে সচেতন মহল বলছেন, সবমিলিয়ে দ্রুত স্থায়ী প্রত্যাবাসন না হলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে যুক্ত হবে নতুন নতুন সংকট।

পার্শ্ববর্তী আরেকটি ক্যাম্পের আরেক নারী রহিমা, চেহারা রোগাক্রান্ত, দেখেই বোঝা যায় অসুস্থ শরীর, চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তিনি আবার ছয় মাসের গর্ভবতী। তিনি জানান, স্বামীর আদেশ মানতে গিয়ে নাকি তার আজ এ অবস্থা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী নিজেরা ব্যবহার না করে অন্যত্র বিক্রি করে দেন বলেও জানান তিনি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা জানালেন, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সংখ্যা বেশি হলেও রাস্তাঘাটে তাদের সেভাবে দেখা মেলে না। এমনকি এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ নারী সন্তান প্রসবের জন্যও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে রাজি হন না। ফলে শিবিরে ঘরের ভেতরে সন্তান প্রসবের সংখ্যা বেশি।

শেয়ার করুন:

Recommended For You