
(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)
২.
দাসপাড়া গাঁয়ের প্রভাবশালী কৃষক আহেদ আলী সরদারের সুন্দরী কন্যা মনোয়ারা। বয়স ১৬ বছর। সদ্য যৌবনে পড়া মনোয়ারা নিজের সুন্দর চেহারার জন্য মনে মনে গর্ববোধ করে। রূপের গর্বে তার পা যেন মাটিতে পড়তে চায় না। কোন ছেলে তার দিকে তাকালে তা সহ্যই করতে পারে না। গায়ে-পড়ে তাকে পাঁচটা কথা শুনিতে দেয়।
কিন্তু গতকাল বিকেলে বালিয়াডাঙ্গী স্কুল মাঠে লাঠি খেলা দেখতে গিয়ে ৬ ফুট লম্বা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী গৌরবর্ণের আজিমকে কাছে থেকে দেখার পর থেকে নিজের অহংকার যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। তার
মনে হয়েছে ফর্সা মুখের পুতুলের মতো চেহারার সুন্দরী যুবতীরা সৌন্দর্যের মাপকাঠি হতে পারে না। বরং লম্বা পেটা শরীরের গৌরবর্ণের পৌরুষদীপ্ত পুরুষরাই বেশি সৌন্দর্যের অধিকারী।
দূর থেকে আবছা আবছা দেখে শুধু নাম শুনেই সে আজিমকে মনে মনে কামনা করত। গতকাল খেলা দেখতে গিয়ে সেই পৌরুষদীপ্ত আজিমকে প্রথম দর্শনেই হৃদয় মন সব সঁপে দিয়ে সে একেবারে ভিখারিনী হয়ে
গেছে। প্রথম যৌবনের প্রথম ভালোবাসার বিরহ যন্ত্রণায় সে একেবারে কাতর হয়ে পড়েছে।
খেলা দেখে বাড়ি ফিরে এসে গত রাতে সে কোন খাবার গ্রহণ করেনি। তাড়াতাড়ি বিছানায় যাওয়া সত্বেও সারারাতে একবারের জন্যও নিদ্রাদেবী তার চোখে আশ্রয় নেয়নি। নরম তুলতুলে বিছানাকে তার মনে হয়েছে কন্টকাকীর্ণ। নির্ঘুম লম্বা রাত যেন কাটতেই চায় না। সারারাত ধরে দুটি প্রশ্নই তার মনে ঘুরপাক খেয়েছে। প্রথমটি হলো- পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর হয় কেমন করে? আর দ্বিতীয়টি হলো- গতকাল খেলা শুরুর আগে ও গলায় মেডেল পরে অভিবাদন জানানোর সময় সত্যিই কি আজিম তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলতে চেয়েছিল?
এতোদিন কেউ তার দিকে তাকলেই বিরক্তিতে মন বিষিয়ে উঠতো। কিন্তু আজ সেই গরবিনী মনোয়ারাই ভিখারিনীর মতো আজিমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার মতো অবলা নারী কিভাবে যোগাযোগ করবে নদীর ওপারের গোহালবাড়ি চরের আজিম লাঠিয়ালের সাথে?
সকালে ঘুম থেকে উঠার পর মনোয়ারার মা নিজের মেয়েকে দেখে চমকে উঠলো। তার বেটির চেহারার এ কী হাল হয়েছে?
– মানিক কী হয়েছে তোর?
– মা আমার কিছুই হয়নি। তুমি কোন চিন্তা করো না তো।
– তাহলে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
– রাতে একটু জ্বর এসেছিল। তাই ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে।
– তাহলে তোর বাজানরে বলে ডাক্তারের কাছ থেকে ঔষধ আনাই।
– না মা, কিছুই লাগবে না। কপালে হাত দিয়ে দেখো আমার শরীরে কোন জ্বর নেই।
– কাল রাতে কিছু খাসনি। রাতে ভাতে পানি দিয়ে রেখেছিলাম। চল দুই মা পুতি মিলে পেয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে একসাথে পান্তা ভাত খাই।
– না মা, আমার খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে নাও। আমি পরে খাব।
অগত্যা মা খাবার খেতে চলে যায়। কিন্তু মায়ের মন বুঝ মানে না। এতো লক্ষ্মী মেয়ে তার। কারো কোন সাতে-পাঁচে থাকে না। মাত্র এক রাতের ব্যাবধানেই তার চেহারার এ কী হাল হয়েছে! ওর বাবা দেখলে তো নির্ঘাৎ হৈচৈ বাঁধিয়ে বসবে।
নির্ঘুম সারা রাত কাটানোর পর আজ সকালেও মনোয়ারার নাস্তা খেতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল খেলা দেখে ফেরার সময় রাত হয়ে যাওয়ায় প্রিয় সখি সানোয়ারার সাথে তেমন কোন কথা বলার সুযোগ হয়নি। আজ আবার স্কুল বন্ধ। খোলা থাকলে স্কুলে যাওয়ার পথে দুই সখি পরামর্শ করে আজিম সমস্যার সমাধান করার একটা পথ বের করার চেষ্টা করা যেত। আজ তাও করা যাচ্ছে না। হঠাৎই তার মনে হয় সানোয়ারাকে বাড়ি থেকে ডেকে আনলেই তো বিষয়টির সুরাহা করা যায়। যে কথা সেই কাজ। তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে রহিমাকে পাঠিয়ে দেয় সানোয়ারাকে ডেকে আনতে। আর আধা ঘন্টার মধ্যে সত্যি সত্যিই সানোয়ারা এসে হাজির।
সানোয়ারাও নির্ঘুম রাত কাটানো মনোয়ারার দীপ্তিময় চেহারার উপর মলিনতার ছাপ দেখে চমকে ওঠে। তাই অনেক আদর মিশ্রিত কন্ঠে সে বলে, মনোয়ারা তোর চেহারার এ কী হাল হয়েছে রে?
প্রিয় সখিকে বুকে জড়িয়ে ধরে মনোয়ারা বলে, সখি তারে ছাড়া আমি বাঁচব না। বল সখি কোথায় গেলে তারে পাব?
– সখি একটু ধৈর্য্য ধর। নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে।
– আমি যে আর দৈর্য্য ধরতে পারছি না।
– সখি তুই শুধু নিজের কথাই ভাবছিস। আমার কথা একবার ভাব। আবুল লাঠিয়ালের জন্য আমার চোখেওতো সারারাত ঘুম আসেনি। কিন্তু তোর মতো আমিতো ভেঙ্গে পড়িনি। আমার প্রেম যদি সত্যি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই আবুল একদিন আমারই হবে।
– সখি তুই ঠিকই বলেছিস, আমার কোন ধৈর্য্য নেই। বাবা মায়ের আদরেই আমার এই অবস্থা হয়েছে। যখন যা চাই বাবা মা তখনই তার ব্যবস্থা করে দেয়। আজ যখন মন থেকে চেয়েও আজিমকে পাচ্ছি না, তখনই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
– কোন কিছু চাইলেই সাথে সাথে তাতো পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও সেই পাওয়ার ফল সব সময় ভালো হয় না। তোর এখন প্রয়োজন ধৈর্য্য ধারণ করে নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করা। সত্যিই তুই আজিমকে ভালোবাসিস কিনা? নাকি পুরাটাই মোহ তা জানার জন্যতো সময়ের প্রয়োজন। মোহের বসে কোন কিছু করলে তোকেতো সারাজীবন পস্তাতে হবে।
– তুই ঠিকই বলেছিস সানোয়ারা। আমি আর ধৈর্য্যহারা হবো না। সত্যিই আমার নিজের সাথে বোঝাপড়া করার দরকার আছে। এখন তুই শুধু বল গতকাল বিকেলে খেলা শুরুর আগে আজিম আবুলের কানে কানে কী যেন বলে আমাদের দুজনের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল কিনা? আবার খেলা শেষে সোনার মেডেল গলার পরে সবাইকে অভিনন্দন জানানোর সময় সে পৃথকভাবে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল কিনা?
– এটা তুই ঠিকই বলেছিস। খেলা শুরুর আগে আজিম ফিসফিসিয়ে আবুলের কানে কানে কী যেন বলে মিষ্টি হেসে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়েছিল। আমি আরও হলপ করে বলতে পারি খেলাশেষে সোনার মেডেল গলায় পরে আজিম তোর দিকে হাত নেড়েছিল। শুধু তাই না আবুলের দৃষ্টিও সব সময় আমার দিকে আটকে ছিল।
– তাহলে বল, এসব দেখার পর কিভাবে নিজেকে ধরে রাখি? তারা দুজন কেন আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, তার কারণ এখনও আমরা জানতে পারিনি।
– সত্যিই যদি এর কোন কারণ থেকে থাকে তাহলে বিশ্বাস কর, তারাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। এখন শুধু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।
– আর যদি তারা যোগাযোগ না করে? আমিতো কখনও আজিমকে ভুলতে পারবো না।
– তোর প্রেম যদি সত্য হয় তাহলে আজিম অবশ্যই যোগাযোগ করবে। আর যদি নাই করে তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। শুধু তুই আমাকে কথা দে, আপাতত মাথা গরম না করে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করবি?
– কথা দিলাম। যতই কষ্ট হোক আমি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করবো। তুই যদি এভাবে বুঝিয়ে না বলতিস তাহলে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যেতাম। তাইতো তোকে এতো মূল্য দেই। অনেক ধন্যবাদ প্রিয় সখি।
– তোর যখন মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে তাহলে আমি এখন বাড়ি যাই?
– বাড়ি যাবি মানে ! কাল রাত থেকে আমি কিছুই খাইনি। দুই সখি একসাথে খাওয়া দাওয়া করব। তারপর তুই বাড়ি যাবি।
– ঠিক আছে তাই করব।
দুই সখি একসাথে খাওয়া দাওয়া করার পর মনোয়ারা বলে, তুই এসে আমার মনটা শান্ত করে দিয়ে গেলি। তুই না থাকলে আমার যে কী হবে, বুঝতে পারি না ।
– আজিম লাঠিয়ালকে পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর সানোয়ারা বিদায় নেয়।