একাত্তরের পরী : পর্ব-১

(কাহিনি সংক্ষেপ : আজিম নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত কৃষক বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা সন্তান পরীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে সে জানতে পারে তার ভালোবাসার একমাত্র অবলম্বন কন্যা পরী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় তার যুদ্ধ-জয়ের সকল আনন্দ। সে তখন পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহীদ হলো। আমি কেন শহীদ হলাম না? শহীদ হলে আমাকে তো এতো নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো না। এই হৃদয়ভাঙা ব্যথা আমি কেমনে সইবো?’)

১.
বিংশ শতাব্দির ষাটের দশকের শেষ ভাগের কথা। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তানের এক অজ পাড়াগাঁয়ের ঘটনা। বর্ষার পানি নদী উপচিয়ে মাঠে ঢুকার আগেই আউস ধান কাটা হয়ে গেছে। সোনার ধানে ভরে গেছে কৃষকের গোলা। এরই মধ্যে বানের পানিতে নদীনালা, খালবিল ভরে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। সেই সময়ে গ্রামের রাস্তাঘাট বলতে কিছুই ছিল না। শুকনা মৌসুমে মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করলেও বর্ষার সময়ে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেতেও নৌকা বা কলাগাছের তৈরি ভুরই (ভেলা) ছিল চলাচলের একমাত্র অবলম্বন। এরই মধ্যে বর্ষা পেরিয়ে শরৎ এসে গেছে। বর্ষার অবিরাম বৃষ্টিতে গাছপালাসহ সমস্ত প্রকৃতি যেন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। এখন ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে সদাই টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। সদ্য জাগা দিগন্ত বিস্তৃত নদীর চর সাদা কাশ ফুলে ছেয়ে গেছে। শিউলি ফুলের সুবাসে ভরে উঠেছে সারা প্রকৃতি। আউস ধান উঠার পর থেকে কৃষকের ঘরে ঘরে নতুন ধানের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে গেছে। এখন তাদের হাতে কোন কাজ নেই। ঘরে খাবারেরও কোন অভাব নেই। তাইতো এই সময়ে গাঁয়ের কৃষকেরা নানা রকম বিনোদনে মেতে ওঠে। তখন যাত্রা পালা থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, কুস্তি ও হাডুডুসহ নানা রকম খেলা নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আজ রবিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকাল থেকেই গাঁয়ের উৎসাহী যুবকেরা টিনের চোঙ্গা ফুকে পাবনা সদর থানার চর তারাপুর ইউনিয়নের প্রতিটা গ্রামে প্রচার করে বেড়াচ্ছে- ‘আজ বিকাল ৪ ঘটিকায় বালিয়াডাঙ্গী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পদ্মা পাড়ের গোহালবাড়ি চরের নয়শাল মালের লাঠিয়াল দলের সাথে সমতলের টাটিপাড়া গাঁয়ের রজমালের লাঠিয়াল দলের মধ্যে সোনার মেডেলের লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হবে।’ চর তারাপুর ইউনিয়ন তথা পাবনা সদর থানার সমগ্র পূর্বাঞ্চল জুড়ে পদ্মা পারের গোহালবাড়ি চরের নয়শাল মালের লাঠিয়াল দলের সুনাম আকাশ ছোঁয়া। আশেপাশের পঞ্চাশ গাঁয়ের মধ্যে এমন কোন লাঠিয়াল দল নেই যারা নয়শাল মালের দলকে পরাজিত করতে পারে। এই দলের শ্রেষ্ঠ লাঠিয়াল আজিমউদ্দিন। সুদর্শন চেহারার সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যুবক আজিম উচ্চতায় ৬ ফুট লম্বা। তার মতো দ্রুত গতিকে কেউ লাঠি ঘোরাতে পারে না। সে যখন শক্ত হাতের লাঠি ঘোরায় তখন তা যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়, শুধু চারিদিকে বোঁ বোঁ শব্দ শোনা যায়। কোন প্যাঁচে কাকে যে কুপোকাত করবে তা প্রতিপক্ষ বুঝতেই পারে না। সাধারণ লাঠিয়ালদের কাছে আজিম এক আতঙ্কের নাম। এলাকার আমজনতা তথা নারী মহলে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তাইতো নয়শাল মালের দলের লাঠি খেলার কথা শুনলেই এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। আজিমের আর একটা অনন্য গুণের কথা না বললে তার উপর অন্যায় করা হবে। সে যেমন ন্যায়পরায়ণ তেমনি পরোপকারী। কোন অন্যায় কাজ দেখলে সে চুপ থাকতে পারে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, অসহায়কে সাহায্য করা তার চরিত্রের একটা বড় দিক। তাছাড়া লেখাপড়ায় প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরুতে না পারলেও সে বেশ রাজনীতি সচেতন। পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকরা শাসনের নামে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর যে শোষণ ও নির্যাতন চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবির সে ঘোর সমর্থক।

টাটিপাড়া গাঁয়ের পাশের দাসপাড়া গ্রামের দুই কন্যা মনোয়ারা ও সানোয়ারা সুজানগর হাই স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়াশুনা করে। একসাথে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে করতে তাদের দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমে উঠেছে। দুজনের মনের যত গোপন কথা তা দুজনকেই শেয়ার করে। দুজন দুজনকে সই বলে ডাকে। তারা দুজনই দেখতে বেশ সুন্দরী। তবে মনোয়ারা যেন তুলনাহীনা। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং, মুক্তার মতো সাদা দাঁত, পিঠে ছড়ানো ঘন কালো কেশ, ঠোঁটে ভুবন ভুলানো হাসি আর কালো ডাগর চোখ দুটি তাকে যেন আরও অনন্যা করে তুলেছে। তার চোখে চোখ পড়লেই যে কোন যুবকের বুকের মধ্যে সাইক্লোন শুরু হয়ে যায়। পথে-ঘাটে অনেক ছেলেই তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু দাসপাড়া গ্রামের ডাকসাইটে কৃষক আহেদ আলী সরদারের কন্যা মনোয়ারার দিকে চোখ তুলে তাকাতে যে কোন যুবককেই দশবার ভাবতে হয়। তাই মনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে ও পথ মাড়ায় না। অন্য দিকে দুই সখি মনোয়ারা-সানোয়ারা টাটি (সমতল) এলাকার কোন ছেলেকেই পাত্তা দেয় না। লাঠি খেলা দেখার সুবাদে মনোয়ারা মনে মনে পছন্দ করে গোহালবাড়ির চরের লাঠিয়াল দলের সেরা লাঠিয়াল আজিমকে আর সানোয়ারা পছন্দ করে আজিমের সহ-লাঠিয়াল আবুলকে। বালিয়াডাঙ্গী স্কুল মাঠে গোহালবাড়ি চরের লাঠিয়াল দলের সাথে তাদের টাটিপাড়া লাঠিয়াল দলের লাঠি খেলা হবে শুনেই দুই সখি সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক বাবা-মাকে রাজি করিয়ে আজ তারা দুজন তাদের পছন্দের মানুষদের লাঠি খেলা দেখতে যাবে।

দুপুরের পর থেকেই বালিয়াডাঙ্গী স্কুল মাঠ আজ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। টাটিপাড়া গাঁয়ের রজমালই এই খেলার আয়োজন করেছে। মাঠে যাতে কোন বিশৃঙ্খলা না হয় তার জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালন করছে। মেয়েদের খেলা দেখার জন্য পৃথক স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই সখি মনোয়ারা ও সানোয়ারা মেয়েদের বসার জায়গার প্রথম লাইনে মাটিতে বসে পড়েছে। খেলা শুরুর ১০ মিনিট আগেই রেফারি হুইসেল বাজিয়ে খেলোয়াড়দের মাঠে আমন্ত্রণ জানানোর সাথে সাথে দুই দলের খেলোয়াড়রা লাঠি হাতে মাঠে নেমে পড়ে। খেলা শুরুর আগে থেকেই মনোয়ারার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ শুরু হয়ে গেছে। কারণ এর আগে কোন দিনই সে ৬ ফুট লম্বা সুদর্শন চেহারার আজিমকে এতো কাছ থেকে দেখেনি। সানোয়ারার অবস্থাও তথৈবচ। কারণ আবুলও দেখতে কম যায় না। এমন সময় আজিম তার দলের লাঠিয়াল আবুলের কানে কানে কী যেন বলে দু সখির দিকে দৃষ্টি হানে। আবার দুজনের কানে কানে কথা। ঠোঁটে তীর্যক হাসি। আর তখনই খেলা শুরুর হুইসের বেজে উঠে। প্রথমে গোহালবাড়ি চরের ও পরে টাটিপাড়া গাঁয়ের লাঠিয়াল দল তাদের ব্যক্তিগত নৈপুন্য প্রদর্শন করে। মনোয়ারার চোখে আজিমের নৈপুন্যের কাছে অন্যদের খেলা একেবারে ফালতু মনে হয়। তারপর শুরু হয় একদলের খেলোয়াড়দের সাথে অন্য দলের খেলোয়াড়দের মুখোমুখি প্রতিযোগিতা। মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় গোহালবাড়ি চরের আজিমের সামনে টাটিপাড়া গাঁয়ের কোন লাঠিয়ালই টিকতে পারলো না। তার লাঠির প্যাঁচের কাছে ২/৩ মিনিটেই মধ্যেই তারা হেরে গেল। আজিমের পরে গোহালবাড়ি দলের আবুল মাঠে নামলো। তার সাথেও টাটিপাড়া গ্রামের কোন খেলোয়াড় জয়লাভ করতে পারলো না। এরপর শুরু হলো গ্রুপ ভিত্তিক প্রতিযোগিতা। প্রতিটা বিভাগেই গোহালবাড়ি চরের লাঠিয়াল দল স্পষ্ট ব্যবধানে টাটিপাড়া গ্রামকে পরাজিত করল। খেলা শেষে গোহালবাড়ি চরের লাঠিয়াল দলকে বিজয়ী ঘোষণা করে স্বর্ণপদক প্রদান করা হলো। ব্যক্তিগত নৈপুন্যের জন্য গোহালবাড়ি চরের আজিমের গলায় স্বর্ণপদক পরিয়ে দেওয়া হলো। আজিম তখন স্বর্ণপদক গলায় পরে সকল দর্শকদের অভিবাদন জানালো। মনোয়ারার মনে হলো অভিবাদন জানানোর ফাঁকে আজিম বুঝি তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু হাসি দিয়েছে। তাই তার বুকের ভেতরে ভালোলাগার জোয়ার বয়ে গেল। খেলায় নিজ এলাকার দলের পরাজয়ে মনোয়ারা-সানোয়ারার মনে কোন দুঃখবোধই স্পর্শ করল না। বরং গোহালবাড়ি চরের জয়লাভে তাদের দুজনের মন আনন্দে নেচে উঠল। খেলা শেষে দুই সখি এক গাদা সুখস্মৃতি বুকে নিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করলো। অন্যদিকে আজিম আর আবুলও মেয়ে দুটির মিষ্টি সুন্দর মুখকে ভুলতে পারলো না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল দুজনের ঠিকানা খুঁজে বের করে যে ভাবেই হোক আবার তাদের সাথে দেখা করবে। আজিমতো আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেই ফেলল, ‘দোস্ত,ওকে ছাড়া আমার জীবনই বৃথা হয়ে যাবে’।

শেয়ার করুন:

Recommended For You

About the Author: জিয়াউল হক