জেলখানা তার ঠিকানা নয়, তবুও তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন এক বাংলাদেশি অভিবাসী। তার নাম আসাদ (ছদ্মনাম)। অভাব অনটনের পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাবেন বলে গেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে। তারপর নিয়তির যাঁতাকলে তার ঠিকানা এখন তুরস্কের বাণিজ্যিক শহর ইস্তাম্বুল। সেখানে এক বন্ধুর বাসায় ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন তিনি।
মুন্সীগঞ্জের এক কৃষক পরিবারে জন্ম আসাদের। কোনো সনদ না থাকলেও কিছুটা পড়াশোনা আছে তার ঝুলিতে। পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে বিদেশমুখী হওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন আরও বছর ছয়েক আগে।
২০১৮ সালের কথা। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে শ্রমিক হিসেবে নিয়মিত পথে ইরাকে আসেন আসাদ। রাজধানী বাগদাদে একটি চাকরিও পেয়ে যান। আয় যা হচ্ছিল, তাতে খুশিই ছিলেন। ভালোই চলছিল সবকিছু।
তিনি বলেন, ‘আমি কাজ করতাম একটি বড় সুপারশপে। বছর দেড়েক কাজ করে কিছু টাকাপয়সাও জমছিল আমার। কিন্তু ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। ওইদিন ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের সাবেক মেজর জেনারেল কাশেম সুলেইমানি
দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। প্রাণ ভয়ে বাগদাদ ছেড়ে কুর্দিস্তানে চলে আসেন আসাদ। সেখানে পৌঁছাতেই দেখা হয় তার দূর সম্পর্কের এক বোনের ছেলের সঙ্গে। তার মাধ্যমে পরিচয় হয় বাংলাদেশে তার পাশের গ্রামের নাঈমের সঙ্গে।’
সবাই মিলে ঠিক করলেন ইরাকে আর থাকা যাবে না। সিদ্ধান্ত নিলেন চলে যাবেন তুরস্কে। কারণটাও তুলে ধরলেন আসাদ। বললেন, ‘তখন জানতে পারলাম অনেক লোক টার্কিতে (তুরস্কে) ঢুকতেছে। ওখানেই এক পরিচিতি, বন্ধুবান্ধব আছে না… যারা আগেই আসছে…ওইভাবে লিংক নিয়ে চলে আসছি।’
সীমান্ত দিয়ে পায়ে হেঁটে অনিয়মিত পথ ধরেই আরও অনেকের সঙ্গে তুরস্কে প্রবেশ করেন আসাদ। বলেন, ‘ইরাকের কুর্দিস্তান দিয়ে তুরস্কে ঢুকি আমরা।’
তুরস্কে পৌঁছে দেশটির সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকদিন ছিলেন তারা। আসাদ বলেন, ‘যে এজেন্টের মাধ্যমে এসেছিলাম আমরা, সেখানে ওই এজেন্টের বাসা ছিল। সেখানেই রাখছিল আমাদের। এক সপ্তাহের মতো ছিলাম। তারপর বাসের টিকিট করে দিছে। তারপর ইস্তাম্বুলে চলে আসি।’
হাঁটা পথের গেইম
ইরাক থেকে তুরস্ক পা রেখে সাহসটা যেন আরও বেড়ে গেলো আসাদসহ দলের আরও কয়েকজনের। এর মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীর খোঁজখবরও নিয়ে নিলেন তারা। ঠিক করলেন, তুরস্কে কাজকর্ম না খুঁজে চলে যেতে হবে গ্রিসে। কারণ, তারা মনে করতেন ইউরোপে পৌঁছালেই বদলে যাবে জীবন।
কয়েকবারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় হতাশ হলেন কিছুটা। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি না আসাদ। তাই খুঁজে বার করলেন অন্য মধ্যস্বত্বভোগীকে।
আসাদ বলেন, ‘অন্য দালাল বললো যে, আমার কাছে ভালো গেইম আছে। এলাকার পরিচয়-টরিচয় পেয়ে, ফুসলিয়ে, নানা কিছু বুঝিয়ে আমাকে রাজি করালো। ওই দালালের মাধ্যমে আবার গেইম মারলাম। দালাল লোকটা ভালো ছিল না। শেষে জানতে পারলাম।’
‘ওই দালালের কাছে যখন টাকা জমা করি, দালাল একটা গেইমে পাঠায়। আধা রাস্তার মধ্যে পুলিশ আমাদের ধরে। মানে সীমান্তেই যেতেই পারিনি। ইস্তাম্বুল ছেড়ে আসতেই একটি চেক পয়েন্টে পুলিশ আমাদের ধরে ফেলে। ধরার পর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্প থেকে নেওয়া হয় ভান শহরে, যা ইরান সীমান্তের কাছাকাছি। ওইখানে প্রায় পাঁচ মাসের মতো রাখা হয় আমাদের।’
বন্দিশিবিরে ভয়ঙ্কর জীবন
ভান শহরের যে জায়গায় আসাদ ছিলেন, তার দেওয়া বর্ণনায় সেটা ছিল মূলত বন্দিশিবির। কাঁপা কাঁপা গলায় সেই বন্দিদশার বর্ণনা করেন ইনফোমাইগ্রেন্টসের কাছে।
তিনি বলেন, ‘ওটা ক্যাম্প না। ওটা আসলে মরণ ফাঁদ। জেলখানা, রুমে রুমে বন্দি। নড়তে চড়তে দিত না। খাবার দাবারের অবস্থা খুবই বাজে। কিছু বললেই মারধর করত।’
খাদ্য সংকট, শারিরীক নির্যাতন, নিপীড়ন যেমন ছিলো, তেমনি আতঙ্কেও থাকতে হতো তাকে। কারণ, ওই বন্দিশিবির থেকে অনেক লোককে নিয়ে রাতের আঁধারে ইরান সীমান্তে ছেড়ে দিত বলে দাবি করেন আসাদ।
টানা পাঁচমাস ওই ক্যাম্পে রাখার পর সেই শিবিরের অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশীকে আবার নিয়ে যাওয়া হয়, ইরান সীমান্তবর্তী আরেকটি ক্যাম্পে। ওই এলাকার সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই আসাদের।
তিনি জানালেন, ‘সেই ক্যাম্পের ভেতর প্রচুর বাংলাদেশি আছেন। কিন্তু নেই কোনো খাবার দাবার। নেই গোসলের কোনো জায়গা। সেখানে আড়াই মাস যাওয়ার পর নাঈম (কুর্দিস্তান থেকে আসাদের সহযাত্রী) অসুস্থ হয়ে পড়ে। খাবার না পেয়ে, দুশ্চিন্তা থেকে অসুস্থ হয়ে যায় সে।’
যে মধ্যস্বত্বভোগীর কথা শুনে গ্রিস যাওয়ার পথে ধরা খেলেন পুলিশের কাছে, তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন আসাদ। উদ্দেশ্য ছিল, তার কাছে দেওয়া অর্থ আদায় করা।
আসাদ বলেন, ‘সে (মধ্যস্বত্বভোগী) আমাদের ফোন ধরতো না। দালাল ফোন ধরলে, তার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারলে খেয়ে-বেঁচে থাকতে পারতাম।’
ওই ক্যাম্পে অনেকে আট মাস, অনেকে নয় মাস, কেউ দেড় বছর ধরে আটকা পড়ে আছেন বলেও জানালেন তিনি। সেই ক্যাম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে আসাদ বলেন, ‘শুকনো রুটি দিত। এমন শুকনো যে এগুলো দিয়ে কাউকে আঘাত করলে মানুষের মাথা ফেটে যেতে পারে। আরেক এক পদের ম্যাগী নুডুলসের মতো নুডুলস দিত। শুধু গরম পানি দিয়ে সেদ্ধ করে দিত। এর মধ্যে আর কিছুই থাকতো না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খাওয়ার জন্য এক লিটার পানি দিত।’
এদিকে, সহযাত্রী নাঈমের শরীরের আরও অবনতি হতে থাকে। কিন্তু ওই ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিল না। অসহায়বোধ করছিলেন আসাদসহ অন্য বাংলাদেশিরা।
হাসাপাতালের দিনগুলো
নাঈমের অসুস্থতার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বন্দিদশা থেকে মুক্তির পথ পেলো আসাদ। আসাদ বলেন, কোনো কথাবার্তা ছাড়া নাঈমকে হাসপাতালে ভর্তির ‘দুই দিন পর আমাকে বের করলো, বললো তুই চলে যা। আমাকে হাসপাতালের গেটে নামিয়ে দিয়ে গেলো। দেখলাম নাইমের এই অবস্থা। সেই হাসপাতালে নাইমের পাশে ছিলাম দেড় মাস।’
অচেনা শহরের ওই হাসপাতালে নাঈমের চিকিৎসা চলেছে প্রায় আড়াইমাস ধরে। তার সঙ্গে মাস দেড়েক ছিলেন আসাদ। বলেন, একপর্যায়ে ‘আমিও অসুস্থ হয়ে যাই। তাই আমি চলে আসি। আড়াইমাস পর মারা যায় নাঈম। মে মাসের ১৮ তারিখ তিনি মারা যান। ২৬ তারিখের দিকে দেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে।’
আবারও ইস্তাম্বুলে ফেরা
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন আসাদ। তার পরামর্শ শুনেই চলে আসেন ইস্তাম্বুলে। ৭/৮ এপ্রিল ইস্তাম্বুল পৌঁছান তিনি। তারপর থেকে সেখানেই আছেন।
তিনি বলেন, ‘১৭ রোজার সময় ইস্তাম্বুলে আসি। প্রায় দেড় মাস পাগলের মতো ছিলাম। বন্ধুর রুমে থাকতাম। বন্ধুর কাছেই আছি। সব খরচ সে করছে।’
ঘরবন্দি জীবন
নিজের কাছে আর কোনো সঞ্চিত অর্থ নেই। ইস্তাম্বুলে বন্ধু আছেন বলে, মাথাগোঁজার ঠাঁই হয়েছে। এমনকি খাবারের ব্যবস্থাটাও বন্ধুই করছেন।
এদিকে, বাংলাদেশে তার পরিবারে আছেন স্ত্রী ও এক সন্তান। সন্তান পড়াশোনা করছেন। আর আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। স্ত্রী-সন্তানের দেখাশোনাটা এখনই তার বাবাই করছেন। বিদেশে থেকেও পরিবারের জন্য কোনো অর্থের যোগান দিতে পারছেন না ৪০ বছর বয়সী এই মানুষটি।
এভাবেই কী তবে জীবন কাটবে?—এমন প্রশ্নের উত্তরে কেঁপে ওঠে তার গলা। আসাদ বলেন, ‘এখন যদি পরিস্থিতি অনুকূলে আসে, তাহলে কাজকর্ম করব। এছাড়া তো আর কোনো পথ নেই। নির্বাচনের পর লোকমুখে শুনছি, কিছু সুযোগ-সুবিধা হয়তো দেবে এই সরকার। কিন্তু ক্লিয়ার না।’
ঘর ছেড়ে বের হতে না পারার কারণ ব্যাখ্যায় আসাদ বলেন, ‘পুলিশ যদি ধরতে পারে আবারো বন্দিখানায় নিয়ে যাবে।’ বন্দিশিবিরের সেই জীবনের কথা মনে পড়লে এখনই গা শিউরে উঠে আসাদের।
ফেরার কোনো পথ নেই
এমন অনিশ্চয়তার চেয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন কি না, জানতে চাওয়া তার কাছে। উত্তরে আসাদ বলেন, ‘ফেরার কোনো পথ নেই। যদি ফিরে যাই — কী করব, বোঝেন তো, অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়ে গেছে। দুই দালালকে টাকা পয়সা দিছি। সেই টাকাও পাই না। দুই দালাল ৬ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে। ইরাকে যা সঞ্চয় সব শেষ হয়ে গেছে।’
একটু থেমে আবারও বলেন, ‘দেশে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। গেলে কী করব? যা সম্বল ছিল সব শেষ। মানুষ অনেক টাকা পাবে। ঋণ করেছি। যেদিন সুযোগ পাব সেদিন থেকে কাজে লেগে যাব, কাজ করব।’
সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস